অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সিয়ামের তাৎপর্য

অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সিয়ামের তাৎপর্য

শামীম ওসমান

সিয়াম হচ্ছে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার একান্ত গোপনীয় একটি বিষয়। সালাত, যাকাত, হজ্জ, এসব প্রকাশ্য  ইবাদত। এ সকল ইবাদত করল মানুষ বুঝতে পারে;  না করলেও বুঝতে পারে অনেক সময় মানুষকে দেখানোর জন্য এগুলো করা হয় । কিন্তু সিয়ামের বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম । সিয়াম স্বয়ং আল্লাহ তাআলার নিজের জন্য একটি ইবাদত।  হাদিসের মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন সিয়াম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য কিন্তু সিয়াম শুধুই আমার জন্য তাই আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দেব।( সহি বুখারী)। সিয়াম  হচ্ছে আত্মশুদ্ধির ও সমৃদ্ধির ঐশ্বরিক ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নিরাপদ ও  সুরক্ষিত থাকবে । সিয়ামের মাধ্যমে আমাদের পরস্পর পরস্পরের প্রতি মায়া-মমতা অনুগ্রহ, উদারতা আরো বেশি বেড়ে যায়। সিয়াম আমাদের নিঃস্ব, অসহায় ,অভাবী ও অনাহারীদের কথা স্মরণ করে দেয়। দারিদ্র্যপীড়িত যে পরিবার এক মুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম করে রাতের বেলায় খেয়ে না খেয়ে শুয়ে পড়ে রাস্তার ধারে অথবা হোটেলের সামনে সন্ধ্যাবেলায় ইফতার মুখে 

তুলতেই সিয়ামের কল্যাণে তাদের কথা মনে পড়ে। চোখের কোনে জমে দুফোঁটা অশ্রু জমে। হৃদয়ের গভীরে তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা জাগে।

সিয়াম হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ একটি মাস এ মাসে সিয়াম সাধনা নফল ইবাদত, কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া ও জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার তাকওয়া সন্তুষ্টি অর্জন করা সহজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন ' হে ঈমানদারগণ তোমাদের ওপর সিয়াম আবশ্যক করা হয়েছে, যেভাবে আবশ্যক করা হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর- যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো। (সূরা বাকারা১৮৩)

পরিপূর্ণ সিয়াম পালনকারী তার সমস্ত বিষয়ে খেয়াল করে। এ ক্ষেত্রে শারীরিক অঙ্গ-প্রতঙ্গের সিয়াম অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যেগুলোর মাধ্যমে আমরা অনেক অবৈধ কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার সুযোগ হয়।

অন্তরের সিয়াম:

 মুমিনের অন্তর রমাদানে সিয়াম পালন করে । অন্তরের সিয়াম হচ্ছে যাবতীয় ঈমান বিধ্বংসী কাজ থেকে তওবা করে নিজেকে পবিত্র করা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা প্রবৃত্তির অনিষ্ট হতে নিজেকে রক্ষা করা।সিয়াম মুমিনের অন্তরকে অহংকার মুক্ত রাখে কারণ অহংকার মানুষের অন্তর কলুষিত করে। অহংকারী ব্যক্তি নির্বোধ ও অতি আমুদে হয়। অন্তর সম্পর্কে রাসূল বলেন, "জেনে রাখ মানবদেহে এমন একটি মদগা বা মাংসপিণ্ড রয়েছে এটি সুষ্ঠু হলে সমগ্র দেহ সুস্থ হয় আর  অসুস্থ হলে সমগ্র দেহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেনে রাখ তা হলো কলব তথা অন্তর। (সহীহ বুখারী) সুস্থ অন্তর হচ্ছে সমস্ত কাজের মূল সফল ও নিরাপদ জীবনের উৎস। সকল কাজের পাপ-পুণ্যের সর্বোপরি সকল নেক আমলের প্রধান কারণ। আল্লাহতা'লা বলেন যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন । (সূরা তাগাবুন ১১) মানুষ যাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করে এমন একটি দেওয়া হল "হে অন্তর পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের ওপর সুদৃঢ় রাখো।(জামি তিরমিযী)  সিয়াম পালনকারী মুমিনের অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত থাকে কেননা হিংসা ইমানকে ধ্বংস করে। অধিকন্তু আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আল্লাহ তায়া'লা বলেন '"তাহলে কি তারা মানুষকে এই জন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ তাদের স্বীয় অনুগ্রহে কিছু দান করেছেন।( সূরা নিসা ৫৪)

জিহ্বার সিয়াম:

মানুষের জিহ্বা হিংস্র জীব জন্তুর চেয়েও ভয়ানক। আগুনের লেলিহান শিখার চেয়েও মারাত্মক। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের জিহ্বা কে লক্ষ্য করে বলতেন বলতেন- হে জিহ্বা,  বললেও ভালো কথা বলো এতে উপকৃত হবে অন্যথায় খারাপ কথা বলা থেকে চুপ থাকো এতে নাজাত পাবে লজ্জিত হতে হবে না।যে ব্যক্তি সিয়াম  অবস্থায় মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, মানুষকে ধোঁকা দেয়, গীবত করে, গালি-গালাজ, ও অশোভন আচরণ করে, তার কিসের সিয়াম? মুসলিম ভাইকে কষ্ট দিলে সিয়াম পালন করে কী লাভ?  এমন সিয়াম কি আদৌ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে? এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে সতর্ক করে বলেন " মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণের জন্য তার নিকট একজন সদা তৎপর প্রহরী রয়েছে।(সূরা কাফ১৮)

রাসুল (সা) বলেন " প্রকৃত মুসলিম সে যার হাত হতে অপর মুসলিম নিরাপদ। (সহীহ বুখারী) 

চোখের সিয়াম :

চোখের সিয়াম হলো চোখের  যত্রতত্র দৃষ্টিপাত থেকে বিরত থাকা। যখন রমাদান মাস আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ে তখন আমাদের উচিত আপন আপন চক্ষুর হেফাজত করা তাকে গুনাহমুক্ত রাখা আর এটি হচ্ছে চোখের সিয়াম সিয়াম পালন ক্ষুধার্ত থাকার ফলে চোখের অনেক উপকার হয় যেমন: এক, চোখের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। দুই,  অপাত্রে কুদৃষ্টির চাহিদা লোপ পায়। দৃষ্টির হিফাযত না করলে করলে কয়েকটি মারাত্মক ক্ষতি রয়েছে ১. কোন কাজে মন বসে না ২. কাউকে দেখার পর তাকে না পাওয়ার বেদনা হৃদয়কে অনবরত দংশন করতে থাকে। ৩. ইবাদতে আত্মতৃপ্তি আসেনা। ৫. বড় গুনাহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দৃষ্টির হেফাজত করার পাঁচটি সুফল রয়েছে ১. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অন্তর উন্মুক্ত থাকে। ২. যাবতীয় জটিলতা থেকে মুক্ত থাকে ৩. আল্লাহর পক্ষ হতে ইলমিষ, মারিফাত, তাকওয়া লাভের পাশাপাশি সৎকাজে তৌফিক নসিব হয়। ৫.সত্যবাদী ও সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়।

কানের সিয়াম:

 অশ্লীল কথা-বার্তা আলোচনা থেকে বিরত থাকা। আর পুণ্যবানদের সবচেয়ে বড় সিয়াম হলো আল্লাহ ক্রুদ্ধ হতে পারেন এমন যেকোন কিছু শোনা থেকে রমাদান ও রমাদান পরবর্তী সময়ে বিরত থাকা। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে যে অনুগ্রহ করেছেন তার ব্যাপারে অনেক মানুষ অবহেলা করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ অনেক জ্বীন ও ইনসান কে আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য তাদের অন্তর আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখে না। কান আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তু মত বরং এর চেয়ে নির্বোধ। উপরন্তু তারাই হলো গাফিল। (সূরা আরাফ) 

একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা হারাম গান-বাদ্য অশ্লীল কথাবার্তা অহেতুক আলাপ-আলোচনা শুনতে শুনতে তাদের কানের প্রাকৃতিক শ্রবণশক্তি নষ্ট করে ফেলেছে ফলে কোরআন তেলাওয়াত সদুপদেশ এখন তাদের কানে যায় না। অথচ কুরআন তেলাওয়াত শরয়ী কাজ। নববী আদর্শ। অধিকন্তু কুরআন তিলাওয়াত শুনলে ইমান বৃদ্ধি পায়। দুশ্চিন্তা ও বিকৃত ধ্যান ধারনা দূরীভূত হয়। 

পেটের সিয়াম: 

হারাম খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি রামাদান দিবসে পানাহার এবং সিয়াম ভঙ্গ কারী অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ কর্ম থেকে বিরত থাকা। কাজেই রমাদানের সিয়াম পরিপূর্ণ করতে হলে অবশ্যই পেটের সিয়াম পালন করতে হবে।সাহরি, ইফতার ও অন্যান্য সময়ে হারাম খাবার বর্জন করতে হবে।এই দৃষ্টিকোণ থেকে সিয়াম পালনকারী তো বটেই সাধারণ একজন মুসলিম সুদ খেতে পারে না। ঘুষ গ্রহণ করতে পারে না। কারণ এতে আল্লাহ তায়ালা ভীষণ ক্রুদ্ধ হন।  আল্লাহ তা'আলা বলেন- "হে ঈমানদারগণ তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। রাসূল (সা) বলেছেন মহান আল্লাহ সুদ,সুদ গ্রহীতা, সুদ চুক্তি লিপিবদ্ধ কারী এবং এব্যাপারে সাক্ষ্যদানকারী অভিসম্পাত করেছেন। আর বলেছেন পাপের ক্ষেত্রে তারা সবাই সমান।(সহীহ মুসলিম) মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ইসলাম আরও বলেন- 'মানুষের নিজ হাতে উপার্জিত অর্থের খাবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন খাবার নেই। আল্লাহর নবী দাউদ (আ)  নিজ হাতে উর্জন করে খেতেন। এ প্রসঙ্গে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর একটি ঘটনা আমাদেরকে আরো বেশি উৎসাহিত করে। একদিন তিনি খাদেমের দেওয়া খাবার খেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন তুমি এই খাবার কোথায় পেলে উত্তরে খাদেম বলেন জাহেলী যুগে আমি গণক বৃত্তি করতাম সেই পেশার উপার্জিত অর্থ দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। এ কথা শোনার সাথে সাথে আবু বকর (রা) গলার ভেতর হাত দিয়ে বমি করে সে খাবার বের করে দেন। তার এই নিষ্ঠা ও সুচিতায় মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি অত্যন্ত খুশি হন। উপরোক্ত বর্ণনা থেকে আমরা বুঝলাম আমাদের সিয়ামকে পরিপূর্ণ করতে হলে সমস্ত বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের হালাল উপার্জনের মাধ্যমে খাবার গ্রহণ করা।  আমরা হালাল-হারামেরবষ বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে আমাদের শ্রবণ শক্তি কোথায় ব্যয় করা হচ্ছে! চোখের দৃষ্টিকে হেফাজত করতে হবে এইসব বিষয়গুলো যথাযথ মেনে সিয়াম পালনের মাধ্যমে আমাদের প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব। 

শামীম ওসমান

সহকারী শিক্ষক

লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। লক্ষ্মীপুর