ভুয়া গ্রাহকের নামে অনন্যা’র ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ মাহফুজ কাদেরীর !

ভুয়া গ্রাহকের নামে অনন্যা’র ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ মাহফুজ কাদেরীর !

ভুয়া গ্রাহকের নামে অনন্যা’র ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ মাহফুজ কাদেরীর !

পাবনার বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ৩৭ কোটি  টাকা নামে বেনমে অত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি (এমআরএ) তদন্তে।

অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা ৮ হাজার সদস্যকে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ফেরত পায়নি। এ কারণে ভুয়া এসব গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এসব গ্রাহকের কোনো অস্তিত মেলেনি তদন্তে। বেনামে  নেয়া ঋণের এই ১৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরী। তিনি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের নামে ধার দেখিয়ে আরও ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া নিজ নামে, স্ত্রীর নামে ও কর্মীদের নামে অগ্রিম টাকা তোলাসহ সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মাহফুজ আলী কাদেরী।

ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে থাকা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তদন্তে এই অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির পাবনাস্থ প্রধান কার্যালয়সহ ৯টি কার্যালয় পরিদর্শন করে মাহফুজ আলী কাদেরীর অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় এমআরএ’র প্রতিনিধিদল।

তবে এরপরও মাহফুজ আলী কাদেরীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অনন্যা সমাজকল্যাণ সংস্থা। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। উল্টো আত্মসাতের টাকা সমন্বয় করতে প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরিচ্যুত করে অনেক কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে করা এমনই দু’টি নালিশি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একটি মামলার তদন্ত শেষ করে সংস্থাটি বলছে, বেনামি ঋণের টাকা সমন্বয় করতেই প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মীদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মিথ্যা মামলা  দেয়া হচ্ছে। গত ১৩ মার্চ পিবিআই সদর দপ্তরে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন পাবনা জেলা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আবু রায়হান।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির উপ-পরিচালক (প্লানিং, রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন) রনজিত কুমার সরকার বলেন, অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার বিভিন্ন কার্যালয়ে পরিদর্শনের সময় নথিপত্র পর্যালোচনা করে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন ধরণে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই অনুযায়ী প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

এমআরএ’র তদন্তে উঠে এসেছে, অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরী প্রতিষ্ঠানের এফডিআর করা প্রায় ৮ কোটি টাকা তুললেও পরে প্রতিষ্ঠানে জমা দেননি। নিজের নামে, স্ত্রীর নামে এবং কর্মীদের নামে প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তারর বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি অনিয়ম, দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের চারটি গাড়ি মাহফুজ আলী কাদেরী নিজে ব্যবহার করতেন। কর্মকর্তারা এমআরএ’র প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন, চাকরি রক্ষার্থে এ ধরণের কাজে তারা রাজি হয়েছিলেন। তবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এ ধরণের কর্মকান্ড বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহফুজ কাদেরী বলেন, ২০১০ সালের পর তিনি আর এই প্রতিষ্ঠানের কোনো দায়িত্বে  নেই। অর্থ আত্মসাতের প্রশ্নই আসে না। এমআরএ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে। আর পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

মাহফুজ আলী কাদেরীর স্ত্রী বর্ণা খাতুন বর্তমানে অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার স্বামীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা মিথ্যা। ঘটনার সময় তিনি প্রতিষ্ঠানের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না। মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে তাকেক দোষারোপ করছে মাইক্রোক্রেডিট  রেগুলেটরি অথরিটি। পরে তারা আবার চিঠি দিয়ে বলেছে, মাহফুজ আলী কাদেরীকে তারা অভিযুক্ত করেনি। পিবিআইয়ের তদন্তের বিষয়ে বর্ণা খাতুন বলেন, কোনো সাবেক কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে না।

অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে পাবনা অ লে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যান্যা ক্ষুদ্র ঋণদাতা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই তারা ঋণ দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি পিকেএসএফ এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আমানত সংগ্রহ করে এ কার্যক্রম পরিচালনা করে।

পিবিআইয়ের তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে, তুরানী সুলতানা নামের এক নারী ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে এই অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার ফিল্ড অফিসার হিসেবে কাজে যোগ দেন। তিনি পাবনা আরবান শাখায় ২০১৪ সালের জুন  থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। করোনা মহামারির কারণ দেখিয়ে তাকে চাকরিচ্য্যুত করা হয়। পরে তিনি প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটিসহ মোট ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা দাবি করেন। এই টাকা দাবি করার পরই তার বিরুদ্ধে ৬ লাখ ১৪ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পাবনা আরবান শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক হরিপদ সরকার গত ডিসেম্বরে তুরানী সুলতানা এবং তার স্বামী আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

পিবিআই বলছে, এটি একটি মিথ্যা মামলা। আত্মসাৎ করা টাকা সমন্বয় করতেই প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মীদের বিরুদ্ধে এমন মামলা দেয়া হয়। মামলার বাদী হরিপদ সরকার এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আবু রায়হান বলেন, শুধু তুরানী সুলতানা নন, আরও কয়েকজন সাবেক কর্মীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মিথ্যা মামলা করেছে অনন্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা। বাদী ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো আলামত উপস্থাপন করতে পারেননি। তিনি মামলায় বলেছেন, ২৪ জন সদস্যের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানে জমা দেননি। তবে এ ধরণে অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।