মূল্যস্ফীতির যে তথ্য সরকার দিচ্ছে তা কতটা বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক?

মূল্যস্ফীতির যে তথ্য সরকার দিচ্ছে তা কতটা বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক?

মূল্যস্ফীতির যে তথ্য সরকার দিচ্ছে তা কতটা বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের হিসেবে দেশে এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও তাদের দাবি এ সময়ে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় কমেছে।

তবে গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির এসব তথ্য উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন এ হারের সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই।অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলছেন বিবিএসের তথ্যে বাজারে পণ্য মূল্যের যে অবস্থা তার প্রতিফলন ঘটেনি।আর গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন যে এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়াটা দেশের বাস্তবতায় বিস্ময়কর ব্যাপার।

মূল্যস্ফীতি কী

সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়াই হলো মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ বেশি টাকা দিয়ে এখন পণ্য বা সেবা কিনতে হচ্ছে।

মূল্যাস্ফীতির কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদদের একটি ব্যখ্যা হলো, বাজারে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়, কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। আর এই মুদ্রাস্ফীতির ফলেই মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে।এপ্রিল মাসেই সরকারের কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছিলেন যে বিশ্ববাজারে সব খাদ্যপণ্যের দাম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

করোনা আর যুদ্ধের প্রভাবে উন্নত বা গরীব কোন দেশই এখন আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাইরে নেই। কোভিডে নাগরিকদের বড় ধরণের প্রণোদনা দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ার রেকর্ড গড়েছে।সেই এপ্রিলে কীভাবে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলো সেটিই এখন বড় বিস্ময় অর্থনীতিবিদদের কাছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গত কয়েকমাস ধরেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.১৭ শতাংশ আর জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।ফেব্রুয়ারি থেকে টানা তিন মাস ধরেই সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের উপরে রয়েছে অর্থাৎ গত বছরের এপ্রিলে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া গিয়েছিল গত মাসে সেই পণ্য বা সেবা পেতে ১০৬ দশমিক ২৯ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে।

এপ্রিল মূল্যস্ফীতি এবং বিবিএস কীভাবে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করে

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এটি দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেও প্রতিষ্ঠানটির হিসেবে এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।তবে এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে দেশের গ্রামাঞ্চলে এবং শতকরা হিসাবে এটি ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

সয়াবিন তেলসহ বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও বিবিএস দাবি করছে যে এপ্রিলে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি আগের মাসের চেয়ে কমেছে।প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন যে এপ্রিলে ভোজ্য তেল ছাড়া অন্য খাদ্যদ্রব্যের দাম কম ছিলো। এ কারণেই আগের মাসের তুলনায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কম এসেছে।

সাধারণত সারা দেশের বাজার থেকে বিবিএসের প্রতিনিধিরা মাসের প্রথম পনের দিন পণ্যের মূল্য সংগ্রহ করেন এবং সেই মূল্য গড় করে বিবিএস মাসিক মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করে থাকে।যদিও গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৫/৬ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার একটি প্রবণতা আছে।

"এখানে যখন খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি হয় তখন খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হয়। আবার খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেশি দেখাতে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হয়। এভাবে একটা গড়পড়তা জায়গায় মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়। কিন্তু তারপরেও এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমা সত্যিই বিস্ময়কর," বলছিলেন তিনি।তিনি বলেন এপ্রিলের পরিস্থিতি দেখেই অর্থাৎ ওএমএসের চাল ডালের জন্য হাহাকার দেখেই সরকার এক কোটি মানুষকে সহায়তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রশ্ন

গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে বাস্তবতা ও সরকারি নানা কর্মসূচি থেকেই প্রতীয়মান হয় যে ওই মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি ছিলো।ফাহমিদা খাতুন বলেন যেভাবে বাজারের গড় করে বিবিএস মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করে সেটি যৌক্তিক নয় কারণ বাজারে সব ক্রেতা সব ধরণের পণ্য কেনে না।

গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, "যেখানে এপ্রিলের এই সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য বিশেষ করে ভোজ্য তেল, আমদানিকৃত পণ্য ও চালের মূল্য বেড়েছে। এর পাশাপাশি জ্বালানি তেল বা পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে। তাহলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিভাবে কমলো তা বোধগম্য নয়"।মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন এবং এর আগে একই প্রশ্ন তুলেছিলো বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম।

মার্চ মাসেই এক সমীক্ষায় তারা বলেছে বিশ্ব বাজারে সরবরাহ সংকট ও উৎপাদনের চিত্র ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার যৌক্তিক নয়।তাদের মতে দেশের মানুষ প্রকৃত যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে সেটি সরকারি পরিসংখ্যানে উঠে আসেনা।

প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রুয়ারি মাসে শহরের প্রান্তিক মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিলো বলে দাবি করেছে, সরকারি হিসেবে যা প্রায় অর্ধেক।সানেম বলেছে বিবিএস খাদ্য পণ্যের যে তালিকা নিয়ে কাজ করে তার বেশিরভাগই দরিদ্র মানুষ ক্রয় করে না।

গ্রাহকরা কী বলছে

ঢাকার শান্তিনগরে নিয়মিত বাজার করেন শরিফা বেগম। তার মতে মার্চ মাসের চেয়ে এপ্রিলে তার বাজার খরচ আরও বেশি ছিলো।"তেলের দাম তো আছেই। গরুর মাংস থেকে আরম্ভ করে সব কিছুই বাড়তি দাম দিয়ে কিনেছি। যে ৪০ টাকার সবজি ৭০/৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

পটুয়াখালী সদরে থাকেন কানিজ ফাতেমা। তিনি বলছেন গত কয়েক মাস ধরেই বাড়তি সব কিছুর দাম। "চাল, ডাল, আটা কিংবা তেল- কোনটার দাম কমেছে গত মাসে? বরং আগের মাসের চেয়ে বেশি খরচ হয়েছে আমার"।অর্থাৎ গ্রাহকদের মন্তব্য অনুযায়ী বাজারে এপ্রিলেও খাদ্য মূল্য ছিলো বাড়তির দিকে।

অথচ দুই হাজার একুশ-বাইশ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।অথচ সরকারি হিসেবেই ফেব্রুয়ারিতে এটি সারাদেশে গড়ে ছিলো ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ আর গ্রাম এলাকায় ছিলো ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে সরকার

এপ্রিলে খাদ্যমূল্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কিছু পদক্ষেপের কথা জানিয়েছিলো সরকার। এগুলো হলো:

•সরকার ইতোমধ্যেই সয়াবিন তেল আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে

•এক কোটি পরিবারের মধ্যে সুলভ মূল্যে পণ্য বিতরণ করছে।

•রোজার আগে চারটি পণ্য এবং রোজায় মোট ছয়টি পণ্য টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

•বাজারে অতিরিক্ত মুনাফা ঠেকাতে সক্রিয় করা হয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থাকে।

তবে অর্থনীতিবিদরা আগেই সতর্ক করেছেন যে পণ্য যে মূল্যে আনা হয় আর বাজারে যে মূল্যে থাকা উচিত সেটি নিশ্চিত করাটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ এবং এটি না করা গেলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকবে।

সূত্র : বিবিসি