সিরিয়ায় নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার ভিডিও ফাঁস

সিরিয়ায় নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার ভিডিও ফাঁস

সিরিয়ায় নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার ভিডিও ফাঁস

নয় বছর আগের ছয় মিনিটের একটি ভিডিও খুব সাড়া জাগিয়েছে৷ দুই সিরীয় যোদ্ধাকে চোখ বাঁধা, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করতে দেখা গেছে সেই ভিডিওতে৷

ওয়াসিম সিয়াম ২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল সেই যে বেরিয়েছিলেন,তারপর আর দামেস্কে নিজেদের বাড়িতে ফেরেননি৷ ৩৪ বছর বয়সি ওয়াসিমের কাজ ছিল তাদামোন শহরের দক্ষিণাঞ্চলের এক সরকারি বেকারিতে ময়দা পৌঁছে দেয়া৷ সেদিন সেই কাজেই বেরিয়েছিলেন৷ ধারণা করা হয়, ময়দা পৌঁছে দিতে ঘর থেকে বের হয়ে কোনো এক সেনা ছাউনির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আটক করা হয় তাকে৷

ওয়াসিম ঘর থেকে বের হবার সময় যেমন সাদা টি-শার্ট আর জিন্স পরেছিলেন, ছয় মিনিটের ভিডিওতে ঠিক সেই পোশাকেই দেখা যায় তাকে৷ তবে তখন তাকে চেনা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল৷ ওয়াসিমের বোন তাসনিম জানান, নিজের ভাইকেই দেখে প্রথমে তিনি চিনতে পারেননি৷ ওয়াসিমকে প্রথম চিনতে পারেন তার বাবা৷ তাসনিম বলেন, ‘‘তাকে (ওয়াসিম) দেখতে খুব অন্যরকম লাগছিল৷ ততক্ষণে হয়ত খুব পেটানো হয়েছে, কিংবা সে খুব ভয় পাচ্ছিল বলেই হয়ত তাকে বেশ অন্যরকম লাগছিল৷‘‘

সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে ১১ বছর ধরে৷ এ যুদ্ধে জড়িত সব পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে৷ ছয় মিনিটের ভিডিওটি করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল, অর্থাৎ ওয়াসিম সিয়াম বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হওয়ার ঠিক দুদিন পরে৷ ভিডিওতে দেখা যায়, বাশার আল আসাদ বাহিনীর অনুগত দুই সদস্য সাদা রঙের একটি ডেলিভারি ভ্যান থেকে ধরে ধরে চোখ বাঁধা মানুষদের নিয়ে আসছেন আর গুলি করে হত্যা করছেন৷

হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা

আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলোকস্ট এবং গণহত্যা বিষয়ের অধ্যাপক উগুর উমিত উংগোর ভিডিওটি হাতে পান ২০১৯ সালে৷ সেই থেকে অজস্রবার দেখে, খুঁটিনাটি বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে দুই হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি৷ এ কাজে তাকে সহায়তা করেছেন সহকর্মী আনসার শাদুদ৷ তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর ওই দুই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন তার্৷৷ জানা গেছে, দুই  হত্যাকারীর একজন নাজিব আল-হালাবি তখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত এক আধা সামরিক বাহিনীতে কাজ করতেন৷ তবে এখন তিনি বেঁচে নেই৷ মাছ ধরার টুপি পরা অন্য ব্যক্তি আমজাদ ইউসেফ এখনো জীবিত৷ এখন তিনি আসাদ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা৷

হত্যাকারীর স্বীকারোক্তি

দুই হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার পর আরো তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘আনা শ' ছদ্ম পরিচয়ে প্রেসিডেন্ট আসাদের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেন আনসার শাদুদ৷ আসাদের ঘনিষ্ঠদের তিনি বলেন, তার বাড়ি হোমসে এবং তিনিও প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের মতো আলাওয়াত গোষ্ঠীর সন্তান৷ এরপর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিরিয়ার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে আনা শ'র বেশ বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে ৷

এক সময় সেই আমজাদের সঙ্গেও পরিচয় হয়ে যায়, আনা, অর্থাৎ আনসার শাদুদের৷ কয়েক দিনের মধ্যে দুজনের সম্পর্ক এমন হয়ে যায় যে, আমজাদ ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার কথাও বলতে শুরু করেন৷ এভাবে ব্যক্তিগত কথা বলতে বলতেই একদিন আমজাদ বলে ফেলেন, ‘‘আমি তো বহু মানুষকে হত্যা করেছি৷'' তার ওই বক্তব্য পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রেকর্ড করা হয় এবং সেই রেকর্ড পৌঁছে দেয়া হয় জার্মান এবং ডাচ আইনজীবীদের কাছে৷

তো পরিষ্কার যুদ্ধাপরাধ'

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার শোয়ার্ৎসও ছয় মিনিটের ভিডিটি দেখেছেন৷ দেখে তার মনে হয়েছে, সিরিয়ার দুই সৈন্য নিরস্ত্র, চোখ বাঁধা মানুষগুলোকে যেভাবে হত্যা করেছেন তা স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ৷ তিনি মনে করেন, পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকণ্ড চালানো হয়েছে৷

হত্যাকারীদের বিচার হবে?

ওয়াসিম নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবার সিরিয়া ছেড়ে জার্মানি চলে আসেন৷ গত জানুয়ারিতে জার্মানির কোবলেনৎস-এর এক আদালত সিরিয়ার কর্মকর্তা আজীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে৷ তাসনিম সিয়াম তারপরও তার ভাই ওয়াসিম হত্যার বিচারের বিষয়ে আশাবাদী নন৷তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি, সব সময় সবার ইতিবাচক চিন্তা করা উচিত৷ কিন্তু আমাদের সব আশা শেষ৷ শুধু বাঁচতে চাই বলেই বেঁচে আছি আমরা৷''

সূত্র  : ডয়চে ভেলে