ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম জন্মদিন আজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম জন্মদিন আজ

সংগৃহীত

আজ পয়লা জুলাই ২০২২ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম জন্মদিন। এই বিশ্ববিদ্যালয় একশ বছর ধরে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিরলস জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান তৈরি এবং বিতরণ করে আমাদের ওপর নিরন্তর আলো ছড়িয়ে চলেছে। দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিক, কবি, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ প্রায় সকল পেশার সফল মানুষের আতুঁড়ঘর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে যার রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা ও সেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবাষির্কী- মুজিববর্ষ একই সঙ্গে উদযাপিত হচ্ছে। মুজিববর্ষ উদযাপনের অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মরণোত্তর সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবান্বিত হবে।

১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। অতপর সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’ পাস হয়। সে সময় যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখ অগ্রগণ্য। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন অগ্রদূতদের আজ গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি।

শিক্ষার্থীদের জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের পয়লা জুলাই। শুরুতে কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভূক্ত বিভাগগুলো ছিল সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১২টি ইনস্টিটিউট, ৮৩টি বিভাগ, ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র, ১২৩টি অ্যাফিলিয়েটেড কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন প্রায় ৪০,০০০। আর, পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় দুই হাজার শিক্ষক।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বদান ও অংশ নেওয়া ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ফলে তাদেরকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে আইয়ুব সরকার ১৯৬১ সালে কুখ্যাত অর্ডিন্যান্স জারি করে। এই অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্যে ষাটের দশক থেকে শিক্ষকরা আন্দোলন করেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকার নিবর্তনমূলক সেই অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩’ জারি করে। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধিচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘…য়ুরোপীয় ভাষায় যাকে য়ুনিভর্সিটি বলে প্রধানত তার উদ্ভব য়ুরোপে। … অথচ এই য়ুনিভর্সিটির প্রথম প্রতিরূপ একদিন ভারতবর্ষেই দেখা দিয়েছিল। নালন্দা, বিক্রমশীলা, তক্ষশীলার বিদ্যায়তন কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার নিশ্চিত কাল নির্ণয় এখনো হয়নি, কিন্তু ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, য়ুরোপীয় য়ুনিভর্সিটির পূর্ব্বেই তাদের আর্বিভাব। তাদের উদ্ভব ভারতীয় চিত্তের আন্তরিক প্রেরণায়, স্বভাবের অনিবার্য্য আবেগে।’

এ কথা অত্যুক্তি হবে না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও আমাদের চিত্তের ও আবেগের প্রেরণা অনেকটা একই ধারায় প্রবাহিত। এ দেশের মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছে বাঙালি জাতিসত্বার বিকাশ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন; বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছেন; অসীম সাহসিকতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্বাধীনতার সংগ্রামে ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে; প্রিয় মাতৃভূমির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে সকল বুদ্ধিবৃত্তিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁরা সদা-সর্বদা সক্রিয় রয়েছেন। তাই, দেশের সকল সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের লালনকারী প্রধান প্রতিষ্ঠানরূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। এখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য।