মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ার বিষয়ে যা বললেন বিক্রেতারা

মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ার বিষয়ে যা বললেন বিক্রেতারা

সংগৃহীত

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশে বেড়ে গিয়েছে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। কিন্তু পোল্ট্রি সামগ্রীর দাম বাড়া নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বিস্তর আলোচনা চলছে।

বিশেষ করে মুরগির গোশত ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারের ব্যয় সামলাতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে।

ঢাকার কালাচাঁদপুর এলাকার বাসিন্দা মিতালি ঘাগরার পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে একজনের উপার্জনে।

আগে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন মুরগি ও দু’দিন মাছ রান্না হলেও এখন এই পণ্যগুলো কেনা কমিয়ে সবজির দিকে ঝুঁকছেন তিনি। ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টানতে হয়েছে তাকে। ফলে আগের মতো ডিম, মাছ, গোশত পাতে ওঠে না এই পরিবারটির।

মিতালি ঘাগরা বলেন, ‘আগে সপ্তাহে আমার দু’ডজন ডিম লাগতো। এখন তো দাম বেড়ে গেছে। এখন হালি ধরে ডিম কিনি। মুরগি আগে সপ্তাহে দু’-তিন দিন খেতাম এখন একদিন খাই। দাম বেড়ে গেলে কী করবো! আয় রোজগার তো বাড়ে নাই।

দাম বাড়ায় বিক্রি কমেছে
বাজারদর নির্ধারণকারী সরকারি সংস্থা টিসিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২ অগাস্ট প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৪৫ টাকা। এখন সেই মুরগির দাম ধরা হয়েছে ১৮৫ টাকা।

অর্থাৎ গত ১২ দিনে মুরগির দাম বেড়েছে ৪০ টাকার মতো। একই হারে বেড়েছে সোনালি মুরগির দাম। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এর চাইতেও ১০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা।

সেইসাথে ডিমের দামও সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এখন এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। যেখানে টিসিবির হিসাবে গত সপ্তাহেও ডজন প্রতি পড়েছিল ১২০ টাকার মতো। অর্থাৎ এক লাফে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

সে হিসেবে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে ১৩ টাকার বেশি। মাছের বাজারেও আগুন।

এ কারণে বাজারে আগের চাইতে বেচা-বিক্রি কমে গিয়েছে বলে জানান দোকানিরা। কালাচাঁদপুর কাঁচা বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী রবিন ইসলাম গত সপ্তাহে দিনে ৫০টি মুরগি বিক্রি করতেন। কিন্তু দাম বাড়ার পর ৩০টি মুরগিও বিক্রি করতে পারেন না।

মাছ ব্যবসায়ী শামীম হোসেনও জানান, যে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত সপ্তাহের চাইতে এবারে তার বিক্রি প্রায় অর্ধেক কমে গিয়েছে। বেলা গড়িয়ে গেলেও বেশিরভাগ মাছ বিক্রি করতে পারেননি তিনি।

দাম কেন বেড়েছে
এই পরিস্থিতির পেছনে উৎপাদকরা মধ্যসত্ত্বভোগী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দুষছেন। পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জামান সেন্টুর অভিযোগ, পরিবহন সিন্ডিকেট মালপত্র আনা নেয়া বাবদ প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া হাঁকছে যা দেখার কেউ নেই।

তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকায় এক গাড়ি নেয়া যেত, সেই গাড়ির ভাড়া চায় ২৬ থেকে ২৭ হাজার টাকা। তাদের মন মতো সব, এখানে আমাদের কিছু বলার নাই। প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’

পরিবহন খরচ বাড়ার পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে মুরগির ফিডের দামও বেড়েছে। যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল না আসায় প্রভাব পড়েছে ডিম ও মুরগির দামে। আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায় মুরগির খাবার প্রসেস করার খরচও বেড়েছে।

তিনি জানান, ‘ছয়টা মুরগির জন্য দিনে এক কেজি ফিড লাগে। এক কেজি ফিডের দাম আগে ছিল ৫০ টাকা। তাই ওই ছয়টা মুরগি থেকে ছয়টা ডিম আমি ৬০ টাকায় বিক্রি করলে দু’দিকেই লাভ থাকতো। এখন সেইম ফিডের দাম হয়েছে কেজিতে ৭৫ টাকা। আবার বিদ্যুতের ইউনিট দামও ১৭ টাকা হয় মাঝে মাঝে। তাহলে এর প্রভাব তো ডিমে, গোশত পড়বেই।’

উৎপাদকরা এই সব বাড়তি খরচের বোঝা বহন করলেও মধ্যসত্ত্বভোগীদের পাল্লায় তারা সেই দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ মিস্টার জামানের। তার মতে, ভোক্তা পর্যায়ে যে হারে দাম বেড়েছে, সেটার সাথে তাদের দামের বিস্তর ফারাক রয়েছে।

এভাবে প্রতিনিয়ত উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকায় প্রান্তিক খামারিরা ক্রমেই ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

দাম বাড়ায় প্রোটিনে ঘাটতি, দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ গ্রাম প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। যেটা অল্প দামে মুরগির মাংস ও ডিম থেকে পাওয়া যেতো বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদরা। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রোটিন গ্রহণের ওপরে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

কারণ টানাপড়েনে থাকা পরিবারগুলো ব্যয় সামলাতে সবার আগে প্রোটিনজাত খাবার কেনা কমিয়ে দেন।

সার্বিক পুষ্টি চাহিদার এই ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছে অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা।

তিনি বলেন, ‘খাবারের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ক্যালোরি ইনটেক কমিয়ে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এতে পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেটায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।’

চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য-বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই।

দারিদ্রসীমার নিচে বা দারিদ্রসীমার ঠিক ওপরে থাকা পরিবারগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারছে না।

সূত্র : বিবিসি