ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র কি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে?

ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র কি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে?

ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র কি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে?

ক্ষোভ আর বিক্ষোভে ইরান এখন উত্তাল। পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনি নামে এক নারীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন বিক্ষোভ হচ্ছে ইরানে।

উনিশশো উনআশি সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে শরিয়া আইনের বিপক্ষে এ ধরণের বিক্ষোভ হয়নি। বিক্ষোভে এখনো পর্যন্ত ৭৬ জন নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বিক্ষোভের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা তাদের মাথার স্কার্ফ আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন। এসব বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা।জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলজির গবেষক সাজ্জাদ সাফাই এর মতে ইরানে বিক্ষোভ নতুন কিছু নয়। কিন্তু হিজাববিরোধী এই বিক্ষোভ দেশটির উপর স্থায়ী চিহ্ন রেখে যাবে।

ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, এই বিক্ষোভের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে নারীরা সামনের সারিতে আছে এবং নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে।তাছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে হিজাব না পরে রাস্তা নেমে আসতে তারা ভয় পাচ্ছে না।

ক্ষোভ দানা বাধছিল

এই আন্দোলন একদিনে তৈরি হয়নি। বহু বছর ধরে নানাভাবে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছে।বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইরান বিষয়ক গবেষক সুলতানা রাজিয়া বলেন, ১৯৭৯ সালে যে শরিয়া আইন চালু করা হয়েছিল, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। সরকার সেটি চাপিয়ে দিয়েছিল।

তার মতে, ইরানের ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক ইসলামকে প্রমোট করেছে। এর প্রভাব পড়েছে জনগণের উপর।"জনগণ মনে করে ইসলাম মানুষকে রক্ষা করার জন্য, এটা নৃশংশতার জন্য নয়। মানুষ মনে করছে যে সরকার ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সেটির অপব্যবহার করছে," বলেন রাজিয়া সুলতানা।

তিনি মনে করেন, আমেরিকা এবং পশ্চিমাদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক ইসলাম ইরানের একটি লেবাস।বর্তমান প্রজন্ম ইসলামি বিপ্লবে ধারণ করে না। ইরানের শাসক গোষ্ঠী যতই চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, বহির্বিশ্বের সাথে সেখানকার জনগণের যোগাযোগ বেড়েছে।অনেকে দেশের বাইরে পড়াশুনা করতে যাচ্ছে কিংবা তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাস করছে। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভিন্ন চিন্তা তৈরি হয়েছে যেটি ক্ষমতাসীনদের সাথে মেলে না।

"এখনকার যে প্রজন্ম আছে তারা চায় না ইরানকে এভাবে দেখতে। তারা চায় ইরানেরও একটা ইমেজ তৈরি হোক," বলেন রাজিয়া সুলতানা।বেয়াল্লিশ বছর আগে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরে সেখানে যত বিক্ষোভ হয়েছে সেগুলো শক্ত হাতে দমন করেছে ইরানের সরকার।

ইরানের তরুণ নাগরিকদের অনেকেই মনে করে তাদের হারানোর কিছুই নেই। দশকের পর দশক ধরে 'ব্রেইন ড্রেইনে'-র শিকার হচ্ছে ইরান। সেখানকার মেধাবীদের মধ্যে যাদের সুযোগ আছে তাদের বেশিরভাগই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।বছরের পর বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতি বেশ ভঙ্গুর।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের শিক্ষক এবং ইরান বিষয়ক পর্যবেক্ষক রোহাম আলভান্দি আমেরিকার সিএনবিসিকে বলেন, যে দ্রুত গতিতে এই বিক্ষোভ ছড়িয়েছে এবং যত দ্রুততার সাথে তারা আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে, সেটি ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

মি. আলভান্দি টুইটারে লিখেছেন, "এই বিক্ষোভ করছে মাহসা আমিনির প্রজন্ম যারা তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে রাষ্ট্রের কঠোর পর্যবেক্ষণ, বিধ্বস্ত অর্থনীতি এবং বিশ্বের অবজ্ঞার ভেতর দিয়ে,"তার মতে এই বিক্ষোভের প্রভাব শুধু ইরানের উপর নয়, দেশটির রাজনৈতিক ইসলামের উপরও এর প্রভাব পড়বে।মি. আলভান্দি লিখেছেন, যেভাবে হিজাব পোড়ানো হচ্ছে সেটি একটি প্রতীকী ব্যাপার। এর মাধ্যমে মানুষ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করছে এবং তারা এমন একটি সেক্যুলার দেশ চাচ্ছে যেখানে রাষ্ট্র মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

ক্ষমতাসীনদের উপর কী প্রভাব?

এই বিক্ষোভ ইরানের ক্ষমতাসীনদের হঠাতে সক্ষম হবে না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।বাংলাদেশে ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইরান বিষয়ক গবেষক রাজিয়া সুলতানা মনে করেন, বিক্ষোভ যদি আরো চলতে থাকে তাহলে হয়তো কিছু সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে।কিন্তু এটি ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারবে না।

"তাদের যে পলিটিকাল স্ট্রাকচার আছে সেটা চাইলেই পরিবর্তন করা যাবে না। ইরানের রাজনৈতিক কাঠামো ওভাবেই তৈরি করা। ফলে সেখানে কোন আঘাত আসবে ন," বলেন রাজিয়া সুলতানা।এর বড় কারণ হচ্ছে দেশটির বিশাল এবং শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনী।

ইরানে রেভ্যুলশনারি গার্ড এবং তাদের আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আরো প্রায় পাঁচ লাখের মতো।দুই হাজার নয় সালে দেশটিতে যখন 'গ্রিন মুভমেন্ট' হয়েছিল তখন নিরাপত্তা বাহিনীগুলো তাদের শক্তি দিয়ে সরকারকে টিকিয়ে রেখেছিল।

মি. সাজ্জাদ সাফাঈ বলেন, এই বিক্ষোভ দমনের জন্য ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী এখনো পুরো শক্তি ব্যবহার করেনি। যদিও কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মীসহ অনেককে আটক করা হচ্ছে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে।তিনি লিখেছেন, ইরানের শাসক গোষ্ঠী জনগণের স্বার্থে না হলেও তাদের নিজের স্বার্থে হিজাবের উপর ছাড় দিলে লাভ হবে।

এখন দেখার বিষয় হচ্ছে এই বিক্ষোভ কতদূর যাবে। এই বিক্ষোভ বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধানের বিষয়টি বিলুপ্ত করা এবং নারীদের হিজাব পরিধানের উপর পুলিশের নজরদারি বন্ধ করা পর্যন্ত যায় কি না।

তবে একসময় যেটা অকল্পনীয় ছিল এই বিক্ষোভের মাধ্যমে সেটি অর্জন হয়েছে বলে মনে করেন মি. সাজ্জাদ সাফাঈ।এখন থেকে অধিকাংশ ইরানি যে বিষয়টিকে অপরাধ মনে করে না সেটি নিয়ে যদি ইরানের সরকার শাস্তি চাপিয়ে দিতে চায় তাহলে তাদের মূল্য দিতে হবে।

সূত্র : বিবিসি