উপাত্ত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাব নিয়ে এখনো এতো উদ্বেগ কেন?

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাব নিয়ে এখনো এতো উদ্বেগ কেন?

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাব নিয়ে এখনো এতো উদ্বেগ কেন?

বাংলাদেশে জরিপ, গবেষণা বা বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়ার সময় মানুষের যেসব ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, সেসব তথ্য বা উপাত্তের সুরক্ষা দিতে প্রস্তাবিত নতুন আইনের আরেকটি খসড়া প্রকাশ করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। তবে এ খসড়া নিয়েও চলছে আলোচনা সমালোচনা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর অনেকেই বলছেন খসড়াটি কোনো পরিবর্তন ছাড়াই আইনে পরিণত হলে এটি নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার বদলে নাগরিকের তথ্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি করবে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য।

এর আগেও আইনটির খসড়া কয়েকবার প্রকাশ করে মতামত গ্রহণ করেছিলো কর্তৃপক্ষ। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও সর্বশেষ খসড়ার ওপর মতামত দিয়েছিলো বিভিন্ন সংস্থা।

এখন আবার নতুন করে খসড়া প্রকাশের পর সেই উদ্বেগ আরও বিস্তৃতই হয়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু বিদেশী রাষ্ট্রদূতও আইনমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আইনটি এভাবে করা হলে কিছু মার্কিন কোম্পানি বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে বলে আশংকা আছে।এ প্রেক্ষাপটে আইনমন্ত্রী এ বিষয়ে বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠকের পরিকল্পনার কথা জানান।

কী আছে প্রস্তাবিত খসড়ায়

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে:

"এই আইন সমগ্র বাংলাদেশে এবং নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য হইবে, যথা : (ক) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো ব্যক্তির উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবহার, বিতরণ বা ধারণ করা;

(খ) বাংলাদেশের বাহিরে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবহার, বিতরণ বা ধারণ করা;

(গ) বাংলাদেশে অবস্থান না করিয়া নিয়ন্ত্রক বা প্রক্রিয়াকারী কর্তৃক কোনো উপাত্ত প্রক্রিয়া করা, যদি উক্তরূপ প্রক্রিয়াকরণ বাংলাদেশে পরিচালিত কোনো ব্যবসায়ের প্রয়োজনে করা হয় বা উপাত্তধারীকে পণ্য সরবরাহ বা সেবা প্রদানসংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত হয় বা ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে উপাত্তধারীর পরিলেখা প্রস্তুতের সহিত সম্পর্কিত হয়।"

অর্থাৎ ব্যক্তি থেকে আরম্ভ করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সবই এ আইনের আওতায় থাকবে।আবার আইনের খসড়ার একটি উপধারা অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা বা কোনো অপরাধ প্রতিরোধ, শনাক্ত ও তদন্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো উপাত্ত সরকার গ্রহণ করতে পারবে।জাতিসংঘ আগেই আইনটির এ বিধান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো।

মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম গোপনীয়তা, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন বিষয়ক একজন গবেষক।মিস্টার করিম বলছেন খসড়াটি আইনে পরিণত হলে সরকার চাইলেই গুগল কিংবা ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানকে যে কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য বা উপাত্ত দিতে বাধ্য করতে পারবে।

অসঙ্গতি কোথায় বা উদ্বেগ কী নিয়ে

মঙ্গলবার খসড়াটি প্রকাশের পর থেকে যেসব অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তার মধ্যে আছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড সম্পর্কে কিছু না বলা, আইন বাস্তবায়নের জন্য সরকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব এবং বিভিন্ন ভাবে চাওয়া মাত্র সরকারকে উপাত্ত দিতেই হবে এমন সুযোগ রাখা।

এমনকি কারও ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে তার প্রতিকার চেয়ে আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগও প্রস্তাবিত আইনে রাখা হয়নি।মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন এর দক্ষিণ এশীয় পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলছেন মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বদলে ঝুঁকিতে পড়তে পারে-এমন অনেক উপাদান এই আইনের খসড়ায় আছে।

তার মতে আইনটির বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ স্বাধীন না হলে সরকার যে কারও কাছেই তথ্য চাইতে পারবে, যা একটি নজরদারির সমাজ তৈরি করবে।দুর্নীতিবিরোধী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি বলছে, যেভাবে এই উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ - কারণ সেখানে এখানে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলছেন এর আগে তারা দুই ধাপে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন যেগুলোর কিছু কিছু নতুন খসড়ায় এসেছে।“কিন্তু এখনো কিছু মৌলিক সমস্যা রয়েই গেছে। যেমন ব্যক্তিগত তথ্য বলতে কি বোঝায় এবং তার কি সুরক্ষা হবে সেটার কোনো ব্যাখ্যা নেই খসড়ায়।”

নতুন আইন অনুযায়ী সব ধরণের প্রতিষ্ঠানকে সরকার চাওয়া মাত্রই নাগরিকের তথ্য সরবরাহ করতে হবে এবং এটি কেউ না করলে জরিমানা বা দণ্ডের বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে।সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন “যদি ডেটা স্থানীয়করণের শর্তকে কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ডেটা সুরক্ষা আইন পাস করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে।”

ডেটা স্থানীয়করণের শর্ত অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের তথ্য বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত কোন সার্ভারে সংরক্ষণ করতে হবে এবং সেই সার্ভারে বাংলাদেশের সরকারী কর্তৃপক্ষকে চাহিদা অনুযায়ী প্রবেশাধিকার দিতে হবে।মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন , “একইভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি কোম্পানিগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর কারণে অপরাধের দায় নিয়ে ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে এখানকার ব্যবসায় তারা বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে।”

তবে এ বিষয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে বৈঠক করার কথা আগেই বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।এরশাদুল করিম বলছেন প্রথমত সব প্রতিষ্ঠানের এ ধরণের তথ্য দেয়ার মতো সক্ষমতাই তৈরি হয়নি। ফলে সরকার বা কর্তৃপক্ষ চাওয়া মাত্র দিতে না পারলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ পাবে সরকার।

“যে কেউ যে কারও তথ্য সংগ্রহ করবে কিছু নিয়ম মেনে। পরে সরকারি সংস্থা যখনই চাইবে তখন সেটি দিতে হবে । না দিলে জরিমানা হবে। বড় অফিস হয়তো পারবে। কিন্তু অসংখ্য ছোট ও মধ্যম অফিসগুলোর জন্য এটি অসম্ভব হবে। ফলে আইনটি আসলে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো একটি নিপীড়ক আইনে পরিণত হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।আইনের খসড়ায় আইনটি বাস্তবায়ন ও দেখভালের জন্য সরকারের অধীনেই একটি সংস্থার কথা বলা হয়েছে যার বিরোধিতা করছে টিআইবিও।

“সরকারি সংস্থা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হবে। এতে নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কারণ আইনটি ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য করার হলেও এর মাধ্যমে আসলে ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও এর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেতে যাচ্ছে সরকার,” বলছিলেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।তার মতে স্থানীয়করণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ যৌক্তিক। এছাড়া সরকারী কর্তৃপক্ষের বদলে একটি স্বাধীন সংস্থাকে আইন বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব না দিলে সংকট তৈরি হবে।

“সরকারী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার কাছে সবার সব তথ্য থাকলে তার সুরক্ষা হলো কী করে। এটাকে কতটা গোপনীয় রাখা যাবে? দেশে যেখানে গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়নি সেখানে সরকার চাইলেই এর অপব্যবহার করতে পারবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।তবে এরশাদুল করিম ও ইফতেখারুজ্জামান দুজনই ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষার জন্য আইনের প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেন।

যদিও মিস্টার করিম মনে করেন প্রস্তাবিত আইনে সব ধরণের উপাত্তকে একটি আইন দিয়ে কাভার দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।“এ ধরণের আইন ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষার জন্য। পার্সোনাল ডেটা আর অর্ডিনারি ডেটার মধ্যে পার্থক্য আছে। সেটি বিবেচনায় না নেয়ায় এটা আসলে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো আরেকটা আইন হতে যাচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।

তার মতে এর বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ স্বাধীন না হলে সরকার যে কারও কাছে তথ্য চাইতে পারবে, যার ফলে নজরদারির সমাজ তৈরি হবে এবং সেটি সবার ওপরে এটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।“আইনটিতে ৭২টি ধারা আছে কিন্তু বিধির কথা বলা হয়েছে ৯৬ বার। অর্থাৎ পরে সরকার বিধি নিজের মতো করে তৈরি করে প্রয়োগ করবে। এমনিতেই খসড়ায় অনেক বিধান আছে যেগুলো উচ্চাভিলাষী, যার ফলে প্রাইভেট সেক্টরের ওপর বড় চাপ আসবে,” বলছিলেন মি. করিম।তিনি বলেন খসড়ায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

খসড়ায় আরও যা বলা হয়েছে

কোন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করতে হলে তার সম্মতি থাকতে হবে। এই সম্মতির প্রমাণের দায়ভার সংগ্রহকারীর ওপর থাকবে।

এই আইনের নিয়ম অনুসরণ না করে কোন স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না। যেসব তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে, তা সংগ্রহকারীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কোন তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না।শিশুদের ক্ষেত্রে তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের পূর্ব সম্মতি ছাড়া কোন তথ্য সংগ্রহ বা প্রক্রিয়া করা যাবে না।এর আগে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় অনেকে আইনটি কার্যকরের জন্য সময় দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন।খসড়ায় আইনটি কার্যকরের জন্য পাসের পর থেকে তিন বছর সময়কালের কথা বলা হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি