ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্সে ফিজিওথেরাপী চিকিৎসা

ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্সে ফিজিওথেরাপী চিকিৎসা

মেহেরুন নেসা

প্রসাব ঝরা বা ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স বয়স্কদের খুবই সাধারন এবং লজ্জাজনক একটি সমস্যা। নিজের অনিচ্ছায় না চাওয়ার পরও প্রসাব ঝরা বা প্রসাব ধরে রাখতে না পারাকে ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স বলে। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা এই সমস্যায় বেশী ভুগেন।

৩০-৬০ বছর বয়সের প্রায় ৩০% মহিলা এবং ১.৫-৫% পুরুষ এই সমস্যায় ভুগেন।

আমেরিকান ইউরোলজিক্যাল এসোসিয়শনের মতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১/৪ - ১/৩ মানুষ এই সমস্যার শিকার।

কারণঃ  প্রসাব ধরে রাখতে না পারা এটি কোন রোগ নয়, এটি উপসর্গ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক খারাপ অভ্যাস, শারীরিক সমস্যা ও অনেক অসুখ থেকে ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স হতে পারে। এর মধ্যে

  • লিঙ্গ: মহিলাদের ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স বেশী হয়। গর্ভধারন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাচ্চা প্রসব, মাসিক, জরায়ু ফেলে দেয়া ইত্যাদি কারণে পেলভিক ফ্লোরের মাংশপেশী দূর্বল ও নিচের দিকে ঝুলে যাওয়ার ফলে এই সমস্যা দেখা যায়। এছাড়া প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বড় হওয়া, প্রস্টেট ক্যান্সার ইত্যাদি কারণে পুরুষদেরও এই সমস্যা দেখা যায়।
  •  বয়স: বয়স বাড়ার  সাথে সাথে ব্লাডার ও ইউরেথ্রার দূর্বল হয়ে যাওয়া, প্রসাব ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স হয়।
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজনের কারণে ব্লাডার ও আশেপাশের মাংশপেশীর উপর অতিরিক্ত চাপের কারণে হাঁচি কাশি দেয়ার সময় প্রসাব ঝরে যায়।
  • কিছু স্নায়ুতান্ত্রিক রোগ (পারকিনসন, স্ট্রোক, ব্রেইন টিউমার, মাল্টিপল স্কে¬রোসিস স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি); ডায়াবেটিস এর জন্যও প্রসাব ঝরতে পারে।
  • প্রসাবের রাস্তায় (ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন) জীবানুর জন্যও হতে পারে।
  • কিছু ঔষধের (হৃদরোগ, ব্লাড প্রেসার, ঘুমের ঔষধ, মাসেল রিলাক্সজেন্ট) জন্যও প্রসাব ঝরতে পারে।
  • এছাড়া ধূমপান, ব্লাডারকে অতিরিক্ত চাপ দেয় এমন খাবার (অ্যালকোহল, ক্যাফেইন,  অম্ল জাতীয় খাবার, চকলেট, সাইট্রাস জাতীয় খাবার, কৃত্রিম মিষ্টি) এর জন্যও প্রসাব করা সমস্যা  দেখা দিতে পারে।

লক্ষণসমূহঃ

১।         হাঁচি, কাশি, হাসি দেয়ার সময় ব্যায়াম বা কোন কিছু উঠানোর সময় প্রসাব ঝরা  (স্ট্রেস ইনকন্টিনেন্স।

২।         হঠাৎ প্রচন্ড বেগে প্রসাব ধরা এবং সেটি কন্ট্রোল করতে না পেরে প্রসাব করে দেয়া (আর্জ ইনকন্টিনেন্স)।

৩।         ব্লাডার ঠিকমত খালি না হওয়ার কারণে কিছুক্ষণ পরপর ফোঁটা ফোঁটা প্রসাব হওয়া।

জটিলতাঃ

            দীর্ঘমেয়াদী প্রসাব ঝরার ফলে তৈরি হতে পারে আনুষাঙ্গিক অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা। যেমন :

         ত্বকের সমস্যা : ভেজা থাকার কারণে যোনীপথ, উরুর মাংশপেশীর ত্বকে র‌্যাশ, জীবাণু এবং ঘা হতে পারে।

         ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলে।

         সামাজিক, কর্মক্ষেত্র, ব্যক্তিগত জীবনে লজ্জা ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মত প্রভাব ফেলে।

প্রতিরোধ :

আমাদের কিছু সচেতনতার মাধ্যমে প্রসাব ঝরা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

            #ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা।

            #নিয়মিত পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম করা।

            #ব্লাডারকে অতিরিক্ত চাপ দেয় এমন খাদ্যভাস ত্যাগ করা ।

            #প্রচুর আঁশ জাতীয় খাবার খাওয়া।

            #ধূমপান থেকে বিরত থাকা।

ফিজিওথেরাপী চিকিৎসা

ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স বা প্রসাব ঝরা সমস্যায় ঔষধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপী  খুবই কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি। নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম ও ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেটরের মাধ্যমে পেলভিক ফ্লোরের মাংশপেশীকে শক্তিশালী করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যে।

(ক) কিছু ব্যায়াম :

(১) পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম : প্রথমে একটি চেয়ারে বসুন। মেরুদন্ড সোজা রেখে একটু সামনের দিকে ঝুঁকুন। এবার প্রসাব ধরে রাখার জন্য দরকারি মাংশপেশীগুলোকে সংকুচিত করুন। এই অবস্থায় ৫-১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। এবার সংকুচিত মাংশপেশী ছেড়ে দিন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি ১০-১৫ বার এবং দিনে ৪ বার করুন।

(২) একটি শক্ত বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে দুটি হাঁটু ভাঁজ করুন। এবার দুই হাঁটুর ফাঁকে একটি ফুটবল রেখে এতে চাপ দিন এবং ৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন এবং ছাড়–ন। এই পুরো প্রক্রিয়াটিও ১০-১৫ বার এবং দিনে ৪ বেলা করুন। এতে উরুর ভেতরের অংশ, প্রসাবের রাস্তা ও পেলভিক ফ্লোরের মাংশপেশীগুলো শক্তিশালী হবে।

(৩) ব্রিজিং ব্যায়াম :

(ক)       সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে দুই হাঁটু ভাঁজ করুন। এবার কোমর উপরের দিকে উঠান, ৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন এবং ছাড়–ন। এটিও আপনি দিনে ৪ বেলা ১০-১৫ বার করুন।

(খ)        ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেশন : রেক্টাস অথবা ভেজাইনার ভিতরে ইলেকট্রোড বসিয়ে স্টিমুলেশনের মাধ্যমে পেলভিক ফ্লোর এর মাংশপেশীকে শক্তিশালী করা হয়।

(গ)        কিছু আচরনগত /ব্যবহারগত কৌশল :

         ব্লাডার ট্রেনিং: প্রসাবের বেগ আসলেও তার ১০ মিনিট পর প্রসাব করার অভ্যাস করা।

         ডাবল ভোয়েডিং : প্রসাব করার পরও কিছু সময় বসে থেকে অপেক্ষা করা। তারপর আবার প্রসাব করার চেষ্টা করা।

         রুটিনমত টয়লেটে যাওয়া : প্রসাব না চাপলেও ২-৪ ঘণ্টা পরপর প্রসাব করার চেষ্টা করা।

মেহেরুন নেসা

ফিজিওথেরাপী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ