বৃষ্টির জন্য পাবনায় ইস্তেসকার নামাজ আদায়

বৃষ্টির জন্য পাবনায় ইস্তেসকার নামাজ আদায়

বৃষ্টির জন্য পাবনায় ইস্তেসকার নামাজ আদায়

বৃষ্টির জন্য পাবনায় সালাতুল ইস্তেসকার নামাজ আদায় করা হয়েছে। পাবনার যুবসমাজের আয়োজনে মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সকাল ১০টায় পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে এই নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ১০/১২ দিন এক নাগাড়ে তীব্র দাবদাহে পাবনাবাসী পুড়ছে। সোমবার (১৭ এপ্রিল) দেশের মধ্যে পাবনায় সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মানুষের ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা হয়ে পড়ে।

তাপমাত্রা কিছুটা কমে মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তথ্য দিয়ে ঈশ্বরদী আবহাওয়া দপ্তরের পর্যবেক্ষক কর্মকর্তা নাজমুল হক আগামী কয়েকদিনের মধ্যে অর্থাৎ ঈদের মধ্যে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানান।

এদিকে আকাশে ছিটে ফোঁটা মেঘের আনাগোনাও নেই। সূর্যের প্রখরতায় আগুনের হল্কা যেন মানুষের শরীরে বিদ্ধ করছে। তাই মানুষ আল্লাহর নিক পানাহ চাচ্ছে। লিল্পী আব্বাসউদ্দিনের সেই বিখ্যাত গান ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে-ছায়া দেরে তুই আল্লাহ------’ এ গানটি যেন এখন মানুষের মুখে গুন গুন সুরে বাজছে।

প্রচন্ড তীব্র গরমে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। বৃষ্টিহীনতায় আম-লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে। জেলার সুজানগর ও ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন জায়গাসহ অন্যান্য উপজেলার বিভিন্ন স্থানের টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট বৃষ্টি চেয়ে সালাতুল ইস্তেসকার নামাজ আদায় ও বিশেষ মোনাজাত করেছেন পাবনাবাসী।

নামাজ শেষে অনাবৃষ্টি ও প্রচন্ড খরা থেকে রেহাই পেতে মহান রবের কাছে বিশেষ মোনাজাত করা হয়েছে। নামাজ ও মোনাজাত পরিচালনা করেন জামেয়া আশরাফিয়া পাবনার শায়খুল হাদিস হযরত মাওলানা হারুনুর রশিদ।

নামাজ ও দোয়ায় ছাত্র, যুবকসহ শতাধিক ধর্ম প্রাণ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। তাওবাতুন নসুহার (একনিষ্ঠ তাওবা) মাধ্যমে আল্লাহর কাছে রহমতের বৃষ্টি কামনা করে অতিরিক্ত ১২ তাকবিরের মাধ্যমে ২ রাকায়াত সুন্নত নামাজ আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থণা করা হয়।

নামাজপূর্বে সংক্ষিপ্ত বয়ানে হারুনুর রশিদ বলেন, পৃথিবীর মাটি যখন শুকিয়ে যায় বা অনাবৃষ্টি ও খরা দেখা দেয় এবং কূপ ও ঝর্ণার পানি কমে যায় অথবা নদী শুকিয়ে যায় তখন সালাতুল ইস্তেসকার নামাজ আদায় করা হয়। এই নামাজ ঈদের নামাজের সময়ের মতোই। মসজিদে নয় বরং খোলা মাঠে জামায়াতের সঙ্গে আদায় করতে হয়।

এদিকে টানা তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জনজীবন। তীব্র তাপদাহে এ জেলার খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। তীব্র গরম ও রোদের তাপের কারণে শ্রমিক, দিনমজুর, ভ্যান-রিকশা চালকরা কাজ করতে না  পেরে অলস সময়ও পার করছেন। একটু প্রশান্তির খোঁজে গাছের ছায়া ও ঠান্ডা পরিবেশে স্বস্তি খুঁজছে মানুষজন।  বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা-ঘাটে লোকজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। আবার অনেকে জরুরি প্রয়োজন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে কাজে বের হচ্ছেন। অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। জেলা সদরের হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেগুলোতেও বেড়েছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী রোগীর সংখ্যা।

পাবনা সদরের রাণীগ্রামের গ্রামের আবজাল হোসেন বলেন, ‘এত তাপ সহ্য করা কঠিন। জমিতে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারলাম না। এখন ছায়ায় বসে আছি। আজ কাজ শেষ করতে দেরি হবে। যে গরম পড়ছে, আর কাজ করতে পারব কিনা জানি না। ধানে সব শিশ বের হয়েছে, প্রচন্ড রোদে তা পুড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন পানি দেয়া লাগছে।  যেখানে আগে সপ্তাহে দু’দিন পানি দিলেই চলত।’

পাবনা সদরের দাপুনিয়া ইউনিয়নের টিকরী গ্রামের ঘর্মাক্ত অবস্থায় ভ্যানচালক শমসের আলী (৫৭) বলেন,‘ বৃদ্ধা মাসহ পাঁচনের সংসার চালাতে এই বয়সে বাড়িতে বসে থাকার সুযোগ নেই। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে একটু বিশ্রামের জন্য শহরের রুপকথা গলিতে একটি বিল্ডিংয়ের পাশে হাফ ছাড়েন। এক পর্যায়ে ভ্যানে সিটে বসেই ঘুমিয়ে পড়েন।

পাবনার ঈশ্বরদী ও সুজানগরে এমনকি জেলা শহরের কিছু কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। ঈশ্বরদী ও সুজানগরে বেশিরভাগ এলাকার নলকূপে হাজার চাপেও উঠছে না পানি। অকেজো পড়ে আছে  সেগুলো। পৌরসভার সাপ্লাই পানির সরবরাহও নিরবচ্ছিন্ন নয়। আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা তীব্র পানির সংকটে পড়েছেন। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে।মঙ্গলবার ঈশ্বরদী শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পুকুরে গোসল সেরে বাড়ির বালতি, কলস ভরে পানি সংগ্রহ করছিলেন বেশ কয়েকজন। খাবার ও রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে ছুঁটতে হচ্ছে যেখানে ডিপ টিউবওয়েল কিংবা সাবমার্সিবল পাম্প আছে। শহরের উমিরপুর, ফতেমোহাম্মদপুর, মাজড়িয়া, স্কুলপাড়া, সাঁড়াগোপালপুর, বিলপাড়া, পাতিবিল, শৈলপাড়া, লোকোকলোনি, নূর মহল্লাসহ প্রায় সব এলাকাতে একই অবস্থা।

ফতেমোহাম্মদপুর, নিউ কলোনি, তিনতলা এলাকার ৫ হাজার বাসিন্দা স্থানীয় মসজিদের সাবমার্সিবল পাম্প থেকে দিনে দুইবার লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম জানান, তিন-চার দিন ধরে বাড়ির নলকূপে পানি উঠছে না। সাহ্রীর সময় ও দুপুরে মসজিদ থেকে লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন। একই কথা জানালেন তিন তলা কলোনির সালেহা বেগম।

বায়তুল হাদি জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি আলাউদ্দিন বিপ্লব জানান, আশপাশের কোনো বাড়ির নলকূপেই পানি উঠছে না।  রোজার দিন এলাকাবাসীর কষ্ট লাঘবে মসজিদ থেকে দুই বেলা পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।ঈশ্বরদী পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের জন্য ১১টি পানির পাম্প রয়েছে। ৭টি পাম্পের মাধ্যমে পৌরবাসীকে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করা হয়। কয়েকদিন আগে উপজেলা রোড ও পশ্চিম অংশের দু’টি পাম্প বিকল হয়ে যায়। সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। তবে পানির চাপ কম থাকার কারণে পানির সরবরাহ স্বাভাবিক নেই।

পৌরসভার পানি শাখার সহকারী প্রকৌশলী প্রবীর বিশ্বাস বলেন, চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ঈশ্বরদীতে পানির স্তর ৩৫ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পৌরসভার মেয়র ইছাহক আলী মালিথা জানান, পৌরবাসীর পানির কষ্ট লাঘবে পানি সরবরাহের প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। কাজ শেষ হলে পানির জন্য আর কষ্ট করতে হবে না।

তীব্র গরমে পাবনায় জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্তের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে বয়স্ক ও শিশু ােগীর সংখ্যা বেশি। প্রতিদিন গড়ে ১০০-১২০ জন শিশু জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আর হাসপাতালের আউটডোরে গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।বৃহস্পতিবার পাবনা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ শিশুদের নিয়ে আউটডোরে এসেছেন অভিভাবকরা। হাসপাতালে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছে। শিশুর পাশাপাশি ভর্তির তালিকায়ও বেড়েছে বয়স্কদের সংখ্যা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, টানা সাত দিনের গরমে শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। শিশুর পাশাপাশি নারী-পুরুষসহ বৃদ্ধরাও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ১০০-১২০ জন শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে।জেলা শহরের শালগাড়িয়া মহল্লার আকলিমা খাতুন (৪) জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আকলিমার মা  রেবেকা বানু জানান, গত কয়েকদিন ধরে মেয়ে জ্বর ও পাতলা পায়খানা ভুগছে। অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে।  

হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে এতে ভয় পাওয়ার বা শঙ্কিত হওয়ায় কোনো কারণ নেই। অভিভাবকরা একটু সচেতন হলেই আক্রান্তের সংখ্যা কমবে।‘হঠাৎ গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ বেড়েছে। প্রতিদিন শিশুদের পাশাপাশি বয়স্করাও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। হাসপাতালের আউটডোরে গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।’