শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে হওয়ার যে বোঝা বইছেন অর্জুন

শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে হওয়ার যে বোঝা বইছেন অর্জুন

শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে হওয়ার যে বোঝা বইছেন অর্জুন

গত মাসে শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে অর্জুন টেন্ডুলকারের আলোচিত অভিষেকের পর তাকে নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ হচ্ছে। ক্রিকেট অনুরাগীদের অনেকেই অর্জুনকে তার কিংবদন্তী বাবার সাথে তুলনা করা শুরু করে দিয়েছেন, অনেকেই যদিওবা অর্জুনের সামর্থ্য নিয়ে সন্দিহান।বিবিসির সুরেশ মেনন লিখেছেন, কেন এ ধরনের তুলনা এই তরুণ পেস বোলারের প্রতি অন্যায়।

তিনি মনে করেন, খুব কম ক্রিকেটারই অর্জুন টেন্ডুলকারের মতো প্রচার পেয়েছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে, এবং এটাই স্বাভাবিক, বিশেষত তার নামের কারণে।বিশ্বের সেরা ক্রিকেটার বলে বিবেচিত একজনের ছেলেকে একই ক্ষেত্রে মাঠে নামতে হলে আলাদাভাবেই সাহসী হতে হয়।সংগীতজ্ঞ মোৎজার্টের দুই সন্তানই ছিলেন দুর্দান্ত পিয়ানিস্ট, একজন ছিলেন অনুবাদক এবং অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আরেকজন ছিলেন কম্পোজার ও শিক্ষক।ভুল করলেও সে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিদ্রুপের শিকার হতে হয়নি এটা নিশ্চিত।অর্জুনের ভাগ্য এতোটা সুপ্রসন্ন নয়।

পাঞ্জাবের বিপক্ষে যেদিন এক ওভারে ৩১ রান হজম করলেন, সেদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের প্রতিক্রিয়াতেই ‘নেপোটিজম’ মানে ‘স্বজনপ্রীতি’ শব্দের ব্যবহার দেখা গেছে।এর আগে যখন অর্জুন সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে দারুণ এক শেষ ওভার বল করেছিলেন, প্রতিপক্ষের ২০ রান প্রয়োজন ছিল আর তিনি দিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ রান, তখন এতো কথা ওঠেনি।

রোমান রাজনীতিক মার্ক অ্যান্থনির বয়ানে ব্যাপারটা এমন, লোকে ভালোটাই ভুলে যায়, মনে রাখে যেটা কদর্য।অর্জুনের বয়স ২৩, বাহাতি এই মিডিয়াম পেস বোলারের বোলিংয়ে এমন কিছু নেই যা আলাদা করে নজর কাড়তে পারে। জাতীয় পর্যায়ে অর্জুন দেশের দ্রুতগতির বোলারদের একজনও নন।

আনরিখ নরকিয়া বা জফরা আর্চারের ধারেকাছেও নেই তার গতি, গড়ে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে বল করে ব্যাটারদের খুব বিপদে ফেলতে পারেন এমন নয়।কিন্তু তারপরেও তাকে নিজের মতো করে এবং তার নিজের সময় ,ত গড়ে ওঠার জায়গা দেয়া উচিত, এটুকু তিনি পেতেই পারেন।অর্জুনের বাবা শচীন টেন্ডুলকার দেশের হয়ে ১৬ বছর বয়সেই খেলা শুরু করেছিলেন, এবং ১৯ বছর বয়সেই বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন।

শচীন টেন্ডুলকার যেদিন খেলা ছেড়ে দেন, ততদিনে তিনি বিশ্বের যে কোনও ক্রিকেটারের চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন, বেশি রান তুলেছেন এবং সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরিও ঝুলিতে তুলেছেন। একজন কিংবদন্তির সে অর্জনকে ছোঁয়া প্রায় অসম্ভব।মনে রাখা দরকার, ডন ব্র্যাডম্যানের ছেলে নিজের নাম পরিবর্তন করে নিজেকে ব্র্যাডসেন নামে পরিচয় দিয়েছেন বহু বছর, তিনি এমনকি ক্রিকেটারও ছিলেননা কখনো।বাবার পথে পা দেয়া একই সাথে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ।

বাবার পরিচয় শুরুর দরজাটা খুলে দেয় ঠিকই, কিন্তু এরপরই তরুণের মাথায় চাপে প্রত্যাশার ভার, অর্জুন টেন্ডুলকার এখানে ব্যতিক্রম কেউ নন।তবে অর্জুনের ক্যারিয়ারের শুরুটা বেশ নাটকীয় ছিল, গেল ডিসেম্বরে গোয়ার হয়ে নিজের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারের শুরুটা তিনি করেছিলেন সেঞ্চুরি দিয়ে।প্রায় দুই বছর মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বেঞ্চে বসে থাকার পরে এই বছরের আইপিএলে প্রথম ম্যাচ খেলার সুযোগ পান অর্জুন, প্রথম ওভারেই একটি উইকেট পাওয়ার সুযোগও তৈরি করেছিলেন।

অর্জুন জানেন তার প্রতিটি সাফল্য মিডিয়ায় নতুন করে হাইপ তৈরি করবে এবং প্রতিটি ব্যর্থতাকেই অতিরঞ্জিত করা হবে।প্রত্যেক বাবাই চান তার ছেলে তাকে ছাড়িয়ে যাক, তার চেয়ে ভালো করুক, কিন্তু খেলাধূলার ক্ষেত্রে সেটি খুব কম ছেলেই পারেন।ওয়েস্ট ইন্ডিজে ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান হিসেবে পরিচিত জর্জ হেডলির ছেলে রন হেডলি দুটি টেস্ট খেলেছিলেন।

কিন্তু তিনি বেশিরভাগ সময় খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের হয়ে, যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন তার ছেলে ডিন এবং দেশের হয়ে ১৫টি টেস্ট খেলেছিলেন।হেডলি উপাধি নিয়ে দুই প্রজন্ম ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া কঠিনই হয়েছিল।ভারতে পতৌদির নবাব ইফতিখার আলি খান ইংল্যান্ড এবং ভারত দুই দলের হয়েই ক্রিকেট খেলেছিলেন। তার ছেলে মনসুর আলি খানকে মনে করা হয় ইতিহাসের সেরা অধিনায়কদের একজন।

সুরেশ মেনন একবার মনসুর আলি খান পতৌদিকে তার বাবার সাথে তুলনা করেছিলেন, জবাবে তিনি বলেছিলেন, “বাবা হয়তো ভালো ব্যাটসম্যান ছিলেন, কিন্তু আমি ভালো ফিল্ডার।”এরপর আসেন অমরনাথদের কথায়- লালা অমরনাথ এবং তার দুই ছেলে সুরিন্দার ও মহিন্দার।বাবা ও দুই ছেলেই, ভারতের হয়ে খেলেছিলেন, তবে অমরনাথদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম করেছিলেন মহিন্দারই।

ইতিহাসের দ্রুততম ফাস্ট বোলার, ইমরান খান, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস ও জোয়েল গার্নারদের বিপক্ষে ব্যাট হাতে মহিন্দার এক মৌসুমে ১১ টেস্টে ১১৮২ রান তুলেছিলেন।সে সময় ৬২ গড়ে পাঁচটি শতক ও সাতটি অর্ধশতক হাঁকান তিনি।তার বাবা কখনোই এতো ভালো ব্যাটসম্যান ছিলেন না, তবে তিনি দারুণ অলরাউন্ডার ছিলেন।এই নামের ভারে পড়েছিলেন সুনীল গাভাস্কারের ছেলে রোহান গাভাস্কারও। সুনীল গাভাস্কার একাই প্রায় দেড় দশক ধরে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপের ভার বয়েছেন।রোহান গাভাস্কারও ভারতের দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, খেলতে পেরেছেন মাত্র ১১টি ওয়ানডে।

সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে এসেছেন ত্যাগনারায়ন চন্দরপল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ক্রিকেটার শিভনারায়ন চন্দরপলের ছেলে।শিভনারায়ন খেলেছিলেন ১৬৪ টেস্ট, রান তুলেছিলেন প্রায় ১২ হাজার। ছেলে ত্যাগনারায়নের মাত্র শুরু, ছয় টেস্টে ইতোমধ্যে একটি ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন তিনি।গায়ানায় বাপ-বেটা দুজন এক দলের হয়েও খেলেছেন, ছেলে অভিষেক ম্যাচে তুলেছিলেন ৪২ এবং ২৯, বাবা সেই ম্যাচে করেছিলেন ৮ এবং ১০৮।

সম্প্রতি ২৬ বছর বয়সী ত্যাগনারায়ান এক সাক্ষাতকারে যেন সব বিখ্যাত বাবাদের সন্তানদের প্রতিনিধিত্ব করে বলেছিলেন, “আমি ও আমার বাবা সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। আমি যা পারি তাই করবো, আমি চেষ্টা করবো নিজের মতো হওয়ার, আমি তার মতো হতে পারবো না।”অর্জুন টেন্ডুলকার কেবল তাই করতে পারবেন যা তার সামর্থ্যে রয়েছে, তার বেশি কিছু চাওয়াটা হবে ভক্তদের বোকামি এবং তার প্রতি অন্যায্য আচরণ।

সূত্র : বিবিসি