কূটনীতিকের নিরাপত্তায় দেশে বিদেশে কোন ধরণের নিয়ম প্রচলিত আছে?

কূটনীতিকের নিরাপত্তায় দেশে বিদেশে কোন ধরণের নিয়ম প্রচলিত আছে?

কূটনীতিকের নিরাপত্তায় দেশে বিদেশে কোন ধরণের নিয়ম প্রচলিত আছে?

ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটেন, আমেরিকা, সৌদি আরব ও ভারতের কূটনীতিকদের জন্য পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়েছে।পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে কূটনীতিকদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

"পররবর্তীতে দেখা গেছে যে এটা আসলে মূলত ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্সের কাজটাই করতো। তাদের যে আসল নিরাপত্তার ব্যবস্থা সেটা অপরিবর্তীত আছে। "তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভালো আছে। এজন্য রাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন দেখছে না বাংলাদেশ সরকার।

"বিদেশী যেসব দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতরা আছেন, তাদের যে বেসিক নিরাপত্তা আছে সেটা আমরা কখনোই কম্প্রোমাইজ করবো না। এটুকু আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি।"পররাষ্ট্র সচিব জানান, কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তার জন্য আনসারের স্পেশাল ব্যাটালিয়ন অনেকদিন ধরেই তৈরি করা হচ্ছিল।

এর আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং সৌজন্যমূলক আচরণের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি প্রটোকল হিসেবে পুলিশি এসকোর্ট সুবিধা দেয়া হতো।অর্থাৎ রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকরা যাতে দ্রুত চলাচল করতে পারে, এজন্য একটি গাড়িতে পাঁচ থেকে আট জন পুলিশের মাধ্যমে রাস্তা ট্রাফিক মুক্ত রাখার বাড়তি সুবিধা দেয়া হতো।

কূটনীতিক প্রতিক্রিয়া

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা হয় বিবিসি বাংলার তরফ থেকে।যুক্তরাজ্যের দূতাবাসের পক্ষ থেকে ই-মেইলে জানানো হয় যে, “তারা তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সুবিধাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।” তবে তারা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবেন না বলে জানান।অন্যদিকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে কোন জবাব মেলেনি। তবে ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিং এ অন্যতম মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।

মি. প্যাটেল বলেছেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে যে কোন স্বাগতিক দেশ সব কূটনৈতিক মিশন এবং তাদের কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে এবং কর্মীদের উপর যে কোনও আক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।"আমাদের কূটনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ," বলেন মি. প্যাটেল।ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের তরফ থেকেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। বিবিসির তরফ থেকে দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোন প্রতিক্রিয়া মেলেনি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা কী সুবিধা পায়?

বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে , বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যে ধরণের 'বিশেষ সুবিধা' পেয়ে থাকেন, বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতরা সে সুবিধা পান না।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, পৃথিবীর কোন দেশেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা ও চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন সুবিধা দেয় না।সাধারণত স্বাগতিক দেশের ওপরেই কূটনীতিকদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিধিবিধান নির্ভর করে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাষ্ট্রদূতদের নিরাপদে কাজ করার জন্য স্বাগতিক দেশের যতটুকু সুবিধা দেয়া দরকার তারা সেটা দেয়। এ নিয়ে স্বাগতিক দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে থাকে। কি ধরণের পরিবেশ তৈরি করলে সবাই নিরাপদে থাকবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।”পাকিস্তান, থাইল্যান্ড এবং উজবেকিস্তানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে এবং আরও অন্তত দশটি দেশে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সোহরাব হোসেন।

"কূটনীতিক হিসেবে অনেক দেশে কাজ করেছি, বাংলাদেশ স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যে নিরাপত্তা দেয় তা আর কোথাও দেখিনি। কখনও কোথাও আমি বিশেষ এসকোর্ট পাইনি, পশ্চিমা দেশে গাড়িতে পতাকা ওড়ানো যেতো না," বলেন মি. হোসেন।"এছাড়া বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের দূতাবাসের বাইরে বা রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে কোন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা থাকে না। বাড়তি নিরাপত্তারক্ষী বা গানম্যান থাকা দূরের কথা। গাড়িতে শুধু চালক ও কূটনীতিক থাকেন"

এ বিষয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশ মনে করে যে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো। আলাদা করে পুলিশ এসকোর্টের দরকার নেই। আন্তর্জাতিক আইনে এ নিয়ে কিছু বলা নেই। তাই তারা এটা কাউকেই দেয় না।"তারা কিভাবে নিরাপত্তা দেবে সেটা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়। আমার কখনও মনে হয়নি বাড়তি নিরাপত্তা দরকার, তাই কখনও চাইনি। তবে চাইলে হয়তো পেতাম,” বলেন মি. কবির

তবে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে সব দেশের সরকারের একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল আছে বলে জানান সোহরাব হোসেন।কোন দেশের কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন দিয়ে তাদের চলাচলের কথা জানালে পররাষ্ট্র দফতর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু কোন বাড়তি নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেয়া হয় না। তবে টাকার বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রটোকল পাওয়া যায়।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সোহরাব হোসেন বলেন, “একবার আমি ইসলামাবাদ থেকে আরেক শহরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা চেয়েছিলাম। কিন্তু এজন্য আমার কাছে পয়সা দাবি করা হয়। তখন আর নেইনি।”তার মতে, কূটনীতিকদের কেমন নিরাপত্তা দেয়া হবে সেটা স্বাগতিক দেশের ওপর নির্ভর করে। যেমন আফগানিস্তান, পাকিস্তানে কিছুটা নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে। আবার রাজধানীর বাইরে গেলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।“কোন বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে আলাদা কথা। না হলে কোন দেশেই বাড়তি কোন সুবিধা দেয়া হয় না। তবে বাড়তি নিরাপত্তা চাইলে তারা ব্যবস্থা করে তবে সেজন্য মোটা অংকের পয়সা গুনতে হয়।” তিনি বলেন,

ভিয়েনা সনদে কী আছে?

ভিয়েনা সনদ আর্টিকেল ২০ এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদূত তার বাড়িতে, অফিসে, গাড়িতে সেই দেশের পতাকা ওড়াতে পারবেন এবং তাদের মনোগ্রাম বা এমব্লেম ব্যবহার করতে পারবে।

এগুলো ব্যবহার করা না করার ব্যাপারে কূটনীতিকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে হোস্ট দেশ কোন বাধা দিতে পারবে না।ভিয়েনা সনদ অনুযায়ী স্বাগতিক দেশকে অবশ্যই সকল কূটনৈতিক মিশন ও কূটনীতিকদের সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। সে হিসেবে কূটনীতিক এবং অবকাঠামোর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের এই বিশেষ নিরাপত্তা দেয়ার কারণ হিসেবে হুমায়ুন কবির জানান, সাধারণত অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হয়।২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর পুরো কূটনৈতিক কমিউনিটির নিরাপত্তার বিষয়ে বাড়তি পদক্ষেপ নেয় সরকার। সে সময় বাংলাদেশ তাদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেই সেই বাড়তি সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

অন্য নিরাপত্তা থাকবে

বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি দূতাবাস, কূটনীতিকদের বাসভবন এবং ক্লাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে সেইসাথে রাষ্ট্রদূতদের পুলিশ প্রদত্ত গানম্যান নিয়োজিত থাকবে।এই সশস্ত্র সদস্যদের বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া আছে।ঢাকায় কূটনৈতিক জোনে ৫৩টি দেশ রয়েছে। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে বিশাল সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সোমবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বলেছেন, সৌদি আরবের ক্লাব, দূতাবাস, বাসভবনসহ কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ৪৮জন পুলিশ মোতায়েন আছে।ব্রিটিশ হাইকমিশনের নিরাপত্তায় ২৯ জন দায়িত্ব পালন করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ১৫৮জন নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন।তাদের এসব নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। শুধুমাত্র ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বাড়তি সুবিধা প্রত্যাহার হবে, বলেন শাহরিয়ার আলম।

সুবিধা পেতে ‘ফি’ দিতে হবে

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, এখন থেকে এই বাড়তি সুবিধা নিতে হলে নির্দিষ্ট ফি' দিতে হবে।

এক্ষেত্রে আনসার ব্যাটালিয়নের সহায়তায় বিশেষ গার্ড রেজিমেন্ট গঠন করার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যাদের মূল দায়িত্ব হবে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেয়া।দূতাবাস চাইলে পয়সা দিয়ে এই বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা নিতে পারবেন বলে সোমবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।গণমাধ্যমকে মি. খাঁন বলেন, বাংলাদেশ আনসার বাহিনীতে একটি চৌকস দল তৈরি করা হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকরা তাদের খরচে এ সুবিধাটি গ্রহণ করতে পারবেন।

কোন দূতাবাস আনসার সদস্যদের এই সুবিধা অব্যাহত রাখতে চাইলে বা বাড়তি সুবিধা নিতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, “কোন বিশেষ উদ্দেশ্য থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। পুলিশের সংকট থাকায় আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত আনসারকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ধীরে ধীরে ভিআইপি ও ভিভিআইপির নিরাপত্তার দায়িত্ব আনসারদের নিয়ে গঠিত গার্ড রেজিমেন্টকে দেওয়া হবে।”

সূত্র : বিবিসি