ম্যানচেস্টার সিটির ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে ওঠার পেছনে তিনটি কারণ

ম্যানচেস্টার সিটির ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে ওঠার পেছনে তিনটি কারণ

ম্যানচেস্টার সিটির ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে ওঠার পেছনে তিনটি কারণ

গেল ছয় বছরে পাঁচটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছে ম্যানচেস্টার সিটি। পেপ গার্দিওলার এই দলটি এবার টানা তৃতীয়বারের মতো শিরোপা নিশ্চিত করলো।সবশেষ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে টানা তিনবার শিরোপা জিতেছিল একই শহরের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে।

সিটি এখন ইউনাইটেডের অন্য একটি রেকর্ডের আরও এক ধাপ কাছাকাছি এগিয়ে গেল। ১৯৯৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জিতেছিল, এখন সিটির সামনে সেই সুযোগ।ট্রেবল হচ্ছে একই মৌসুমে লিগ শিরোপা, ঘরোয়া কাপ শিরোপা ও মহাদেশীয় শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করা।

এফ এ কাপের ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ইন্টার মিলান- এই দুটি ম্যাচ জিতলে ম্যানসিটির এই দলটি ‘অমরত্ব লাভ করবে’ বলছেন ইংল্যান্ডের সাবেক ফুটবলার অ্যালান শিয়েরার।৩রা জুন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে মুখোমুখি হবে পেপ গার্দিওলার এই ‘অপ্রতিরোধ্য’ দলটি, এরপর ইস্তানবুলে খেলবে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল।

সব পজিশনেএকজন নায়ক'

শনিবার রাতে আর্সেনাল নটিংহ্যাম ফরেস্টের কাছে হেরে যাওয়ার পরই সিটির লিগ জয় নিশ্চিত হয়েছে। দলটির ফুটবলাররা তখন এক সাথে বসে টেলিভিশনে এই ম্যাচ দেখছিল, এবং শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে তারা উল্লাসে ফেটে পড়েন।

ম্যানচেস্টার সিটির ইতিহাসে এটা নবম প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, যার সাতটিই এসেছে ২০১১-১২ মৌসুমের পর থেকে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেরও একই রেকর্ড। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে সাতবার শিরোপা জিতেছিল এই ক্লাবটি। লিভারপুল এমন সময় কাটিয়েছিল ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এর মধ্যে।অ্যালান শিয়েরার বলছেন, সিটি এমন একটা সময় কাটাচ্ছে যা মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে।ম্যানসিটির সাবেক গোলকিপার শে গিভেন বিশ্বাস করেন গার্দিওলার এই দলটি ইতিহাসের সেরা দলগুলোর একটি।

তিনি বলেন, “অবিশ্বাস্য একটা দল। দেখেন সব জায়গায়, সব পজিশনে একজন নায়ক আছে, রাইট-ব্যাক হোক আর সেন্টার ব্যাক অথবা মিডফিল্ড”।ম্যানসিটির এই দলে কোনও দুর্বলতা দেখছেন না তিনি, “কেভিন ডি ব্রুইনা, বার্নার্দো সিলভা, মাহরেজ- গোটা মাঠেই আপনি তাদের আধিপত্য দেখতে পাবেন।”

এখানে রিকো লুইসের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়, মাত্র ১৮ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডার খেলেছেন সর্বত্র। তিনি জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ফিলিপ লাম ঘরানার ফুটবল খেলেছেন।গার্দিওলার এই দলটিতে অপ্রত্যাশিতভাবেই সুযোগ পেয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করেছেন সদ্য কৈশোর পেরোনো এই ফুটবলার।

এর্লিং হালান্ডের রেকর্ড

এই মৌসুমে ৪৮ ম্যাচ খেলে ৫২ গোল করেছেন এর্লিং হালান্ড। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ৩৩ ম্যাচে করেছেন ৩৬ গোল যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ম্যানসিটির দুর্দান্ত এই দলটিকে আরও ক্ষুরধার করার পেছনে আছেন তিনিই।ইংল্যান্ডের সাবেক স্ট্রাইকার অ্যালান শিয়েরার মনে করেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে হালান্ড দারুণ কিছু করে দেখাবেন।

তিনি বলেন, “সিটিকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসতেই হালান্ডকে কেনা হয়েছিল এবং তিনি ঠিক সেটাই করেছেন।”হালান্ডের হাবভাবের দারুণ ভক্ত শিয়েরার, “হালান্ড ক্ষুধার্ত, একটা গোলের জন্য মরিয়া হয়ে থাকেন।”নরওয়েজিয়ান হালান্ড সবার নজরে আসেন জার্মান লিগের ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে খেলার সময়ে।তবে তার জন্ম ইংল্যান্ডের লিডসে, ২০০০ সালে।

তার বাবা এলফি হালান্ডও এক সময় ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে খেলতেন। আর মা গ্রি ম্যারিটা ব্রট খেলতেন হেপটাথলন।বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে ৬৭ ম্যাচে ৬২ গোল করেছিলেন তিনি। নরওয়ের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ২৩ ম্যাচে গোল করেছেন ২১টি।এখন তাকে বর্ণনা করা হচ্ছে আধুনিক ফুটবলের 'গোলমেশিন' হিসেবে।

যে কোনও দলকে চাপে রাখার ক্ষমতা

এই মৌসুমে আর্সেনাল যখন দিনের পর দিন এক নম্বরে থেকে খেলা চালিয়ে যাচ্ছে তখনও ম্যানচেস্টার সিটি নিজেদের স্থির রেখে স্বাভাবিক খেলা চালিয়ে গেছে। বিশ্বাস রেখেছে যেকোনও মুহূর্তেই এমন সময় আসবে যখন আর্সেনাল পা হড়কাবে।ঠিক সেটাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত।ম্যানচেস্টার সিটি প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে পারে এবং এই চাপে প্রতিপক্ষ ভেঙ্গে পড়ে- এমনটা দেখা গেছে অনেক ম্যাচেই।

ম্যানসিটির রেকর্ডই বলছে, তারা প্রতিপক্ষের ওপর একটা মানসিক চাপ বজায় রাখতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিভারপুল ও আর্সেনাল এই চাপে টিকে থাকতে পারেনি।য়ুর্গেন ক্লপের অধীনে লিভারপুলের আধিপত্য ফিরে এসেছিল কেবল এক মৌসুমের জন্য, তাও আবার ৩০ বছরে প্রথমবার অ্যানফিল্ডে ফিরেছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ট্রফি।

বাকি সময় পেপ গার্দিওলার ম্যানসিটির চাপে পড়ে দুর্দান্ত মৌসুম কাটিয়েও শিরোপা ঘরে তুলতে পারেনি লিভারপুল।দুই হাজার উনিশ সালে টানা ১৪ ম্যাচে জিতে ম্যানচেস্টার সিটি শিরোপা নিশ্চিত করেছিল, যা অনেকে বলেছিলেন ‘অলৌকিক ব্যাপার’।

আর্সেনালেরও এবার একই হাল। এপ্রিল মাসের এক তারিখেও লন্ডনের ক্লাবটি ছিল পয়েন্ট তালিকার এক নম্বরে।তারপর আট ম্যাচে মাত্র ২টিতে জয় পেয়েছে, তিনটি ড্র ও তিনটি হেরে গেছে মিকেল আর্টেটার দল।যার মধ্যে আছে ম্যানসিটির বিপক্ষে ৪-১ গোলের হার। অনেকে মনে করেন এই ম্যাচেই আর্সেনাল মনোবল হারিয়ে ফেলে। এতো লম্বা সময় এক নম্বরে থেকে এমন হার অনেক দলকেই ভেঙ্গে দিতে পারে।

ম্যানচেস্টার সিটির মধ্যে প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা আছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে স্প্যানিশ ক্লাব রেয়াল মাদ্রিদকে হারিয়েছে ৪-০ গোলে। মৌসুমের শুরুর দিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়েছে ৬-৩ গোলে।প্রিমিয়ার লিগের সাবেক স্ট্রাইকার গ্লেন মারে বিবিসি স্পোর্টসকে বলেছেন, “ম্যানচেস্টার সিটির দলটা ভয়ানক, তারা জয় তুলে নিয়ে সেটা নিয়ে আর ভাবে না। একটা আবেগহীন দল। কোনও কিছুতেই তাদের কিছু যায় আসে না।"

গ্লেন মারে ১৯৯৯ সালের স্মৃতিচারণ করছিলেন, যেবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ট্রেবল জিতেছিল, “ওই বছর ইউনাইটেড দল যা করেছিল তাতে অনেকেই দলটার সমর্থক বনে গিয়েছিল আমার মতোই। সিটির এই দলটাও অমরত্ব লাভ করবে।”পেপ গার্দিওলার জন্যও এটা দারুণ এক মুহূর্ত। তিনি বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ ও ম্যানচেস্টার সিটি- এই তিন ক্লাবের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মাত্র তিনবার লিগ শিরোপা মিস করেছেন।এর আগে বার্সেলোনা ও বায়ার্ন মিউনিখের হয়েও তিনি হ্যাটট্রিক শিরোপা জিতেছেন।

সূত্র : বিবিসি