শিল্পোৎপাদনে ধস বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে

শিল্পোৎপাদনে ধস বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে

ফাইল ছবি।

বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে শিল্পোৎপাদনে ধস নেমেছে। একদিকে উৎপাদন কমেছে, অপরদিকে ব্যয় বাড়ছে। লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি চলছে গ্যাস সংকট। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তারা বেশি দাম দিয়ে গ্যাস কিনছেন। কিন্তু এ খাতে বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না। গ্যাসের অভাবে গ্রিডের বিদ্যুৎ দিয়ে কারখানা চালাতে গিয়ে এখন ‘মাথায় হাত’। বিদ্যুৎ না থাকায় দিনে রাতের অধিকাংশ সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছেন না। ফলে বড় অঙ্কের টাকা জরিমানা গুনতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় অনেকের অর্ডারও বাতিল হয়ে যাচ্ছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোমতে টিকে থাকলেও ছোটগুলোর অবস্থা খুবই করুণ।

শিল্প-কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, ঘন ঘন লোডিশেডিংয়ের কারণে বিকল্প উপায় হিসাবে জেনারেটরের মাধ্যমে কারখানা সচল রাখতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। কিন্তু তাতেও শতভাগ উৎপাদন করা যাচ্ছে না, উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে। এছাড়া ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় কারখানার মূল্যবান যন্ত্রপাতিরও ক্ষতি হচ্ছে। উৎপাদন ধসের জন্য বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস সংকটকেও দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ-একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে ওই কারখানা চালু করতে কমপক্ষে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। একবার কারখানা শাটডাউন হলে সেখানে যত কাঁচামাল আছে সব ফেলে দিতে হয়। ধুয়েমুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও নতুন কাঁচামাল তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। এ সময় বেকার বসে থাকে শ্রমিকরা। কিন্তু ওই সময়ের জন্যও তাদের বেতন দিতে হয়। এতে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।

রাজধানী ঢাকার পাশের শিল্প অধ্যুষিত জেলা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বিভিন্ন কল-কারখানায় উৎপাদনে ধস নেমে এসেছে। শিল্প মালিকরা লোকসান দিয়ে কোনোমতে শিল্প টিকিয়ে রেখেছেন বলে জানান। উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে জেলার শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় লোডশেডিং কম করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শিল্পমালিক। এছাড়া লোডশেডিংয়ের আগাম তথ্য জানানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।

বিদ্যুতের অভাবে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসার পানির উৎপাদনও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ব্যাটারিচালিত পরিবহণ চালকসহ বিদ্যুৎনির্ভর বিভিন্ন পেশার মানুষের আয় কমেছে লোডশেডিংয়ের কারণে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও সে তুলনায় উৎপাদন না হওয়ায় লোডশেডিং বাড়ছে সারা দেশে। খোদ রাজধানীতেই দিনে-রাতে ৮-৯ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকার বাইরে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকার খবর পাওয়া গেছে। সরকারি হিসাবে বিদ্যুতের ঘাটতি আড়াই হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও বাস্তবে এর পরিমাণ সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট হবে বলে খাতসংশ্লিষ্টদের অনেকেই জানিয়েছেন। কারণ মঙ্গলবার থেকে দেশের সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা বন্ধ হয়ে গেছে। সেখান থেকে ১২শ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ যোগ হতো জাতীয় গ্রিডে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা তাদের নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ) দিয়ে চলে। আমরা তাদের গ্যাস সরবরাহ করছি, তারা সে গ্যাস দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কারখানা সচল রাখছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এখন পর্যাপ্ত গ্যাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও গ্যাস বিতরণে আমরা শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তবে তিনি বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে ছোট ও মাঝারি আকারে শিল্প-কারখানাগুলোর ক্ষতি হচ্ছে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, লোডশেডিংয়ে ছোট ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠান অধিকাংশ বন্ধ হয়ে আছে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি থাকলেও তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জ্বালানির অভাবে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা যাচ্ছে না। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আশা করছি। সবাইকে আরেকটু ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান তিনি।

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানায়, জেলায় প্রায় দুই হাজারের মতো শিল্প-কলকারখানা থাকলেও এসব কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৬৫০ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে এর অর্ধেক।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘আজকের এই পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতির চেয়ে সরকার বেশি দায়ী। ভুলনীতির কারণে প্রাথমিক জ্বালানির সংস্থান না করে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়ছে। এতে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে দফায় দফায়। অতিরিক্ত দাম দিয়েও মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। সামনে লোডশেডিং আরও বাড়বে।’

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘১৫৫টি ফিডারের মাধ্যমে তাদের এলাকার গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়। এর মধ্যে ১০০টি ফিডারে শিল্প-কারখানা রয়েছে। বাকিগুলো আবাসিক। শিল্প-কারখানায় লোডশেডিং না করতে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে তা পুরোপুরি মানা সম্ভব হচ্ছে না।’

গাজীপুর মহানগরীর মিম ডিজাইনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বিকল্প ব্যবস্থায় জেনারেটর চালিয়ে কারখানা সচল রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বেশি সময় ধরে জেনারেটর চালু রাখতে গিয়ে জেনারেটরও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তা মেরামত করতে সময় ও অর্থ দুটিই অপচয় হচ্ছে।’

ময়মনসিংহের ভালুকায় লোডশেডিং এবং গ্যাসের অপ্রতুল সরবরাহ ও সরবরাহ লাইনে চাপ কম থাকায় কারখানাগুলোতে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে অনেক কারখানা মালিক তাদের কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। আর তা হলে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন। উৎপাদনে ধস নামায় এরই মধ্যে অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই করছে বলে তথ্য মিলেছে।

ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ছোট-বড় দুইশর বেশি শিল্প-কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৩০টি ডাইং ফ্যাক্টরি। একদিকে ঘন ঘন লোডশেডিং, অন্যদিকে অপ্রতুল গ্যাস সরবরাহের কারণে এসব কারখানার উৎপাদন প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। উপজেলায় পিডিবি প্রতিদিন গড়ে ১২-১৪ ঘণ্টা এবং আরইবি ১৬-১৭ ঘণ্টা লোডশেডিং দিচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে।

মল্লিকবাড়ী ইউনিয়নের গাদুমিয়া গ্রামের তাইপে বাংলা ফেব্রিক্সের ডিজিএম আশিকুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট থাকায় আমাদের ২৭টি মেশিনের মধ্যে দু-একটি করে মেশিন চালু রেখেছি। লোডশেডিং ও গ্যাসের প্রেশার কম থাকায় কাপড়ের রং ঠিকমতো আসছে না ফলে সঠিক সময়ে মাল উৎপাদন করতে পারছি না। তাই বায়ারদের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ হচ্ছে। আমাদের কোম্পানি শতভাগ রপ্তানিমুখী। এটি বন্ধ হলে প্রায় ৮শ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। গত মাসে শ্রমিকদের বেতন ভর্তুকি দিয়ে কষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।’

নারায়ণগঞ্জ এলাকার একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সিইও লুৎফুর রহমান কাকন যুগান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে গার্মেন্ট, টেক্সটাইল ও হোসিয়ারি শিল্প-কারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আগে থেকেই নারায়ণগঞ্জের কারখানাগুলোতে ছিল গ্যাস সংকট। গ্যাসের চাপ না থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হতো। বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চলত উৎপাদন কাজ। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে এ পদ্ধতিতেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে কারখানার অর্ডার। চাকরি হারাচ্ছে বহু শ্রমিক। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি খাতে চাপ বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন ব্যয়। এছাড়া ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে না পারলে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়তে হবে। এরই মধ্যে রপ্তানি আদেশ কমতে শুরু করেছে।

ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীর একটি নিটিং কারখানার ম্যানেজার শামীম উদ্দিন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কারখানায় অর্ডার কমেছে। কারখানায় তেমন কাজ নেই। মালিক ভর্তুকি দিয়ে কারখানা চালাচ্ছেন। এখন যে অবস্থা চলছে করোনার সময়ও এমন ছিল না। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কী হবে জানি না।’

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ব্র্যান্ড ক্রেতারা পোশাকের দরে এক সেন্টকেও খুব গুরুত্ব দেন। অন্য কোথাও কম দাম পেলে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র ভাববে না।’

সিরাজগঞ্জ জেলার এক উদ্যোক্তা জানান, এখানকার ৯ উপজেলায় ৫ লাখ তাঁত রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ তাঁতই বিদ্যুৎচালিত পাওয়ারলুম। লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন কমে তাঁত মালিকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে মজুরি কমে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শ্রমিকদের।

সদর উপজেলার পাইকোষা গ্রামের গামছা তৈরির তাঁত মালিক আবুল হোসেন বলেন, ‘দিনে ৩-৪ বারে দুই থেকে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। আমরা চরম লোকসানে পড়েছি। সুতার মহাজনের পাওনাও দিতে পারছি না। এনজিও বা ব্যাংকের কিস্তি দিতেও হিমশিম খাচ্ছি। লোকসানে পড়ে অনেকেই তাঁত বিক্রি করে দিচ্ছে।’

তৈরি পোশাক কারখানার পাশাপাশি সিরামিক শিল্পে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিরামিক তৈরির জন্য চুল্লির তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে নিতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। তার আগেই যদি বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে আবার নতুন করে চুল্লি গরম করতে হয়। এতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।