বাড়ছে নদ-নদীর পানি, উজানের ঢলে বন্যার শঙ্কা

বাড়ছে নদ-নদীর পানি, উজানের ঢলে বন্যার শঙ্কা

সংগৃহীত

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানি এখন বিপৎসীমার খুব কাছাকাছি। উজানের ঢলে উত্তরের বেশ কয়েকটি নদীর পানি গত কয়েক দিনের মধ্যেই অনেকটা বেড়েছে। নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকা ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে দুই দফা বন্যা হয়। প্রথম দফা মে মাস থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। আর দ্বিতীয় দফা আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। এবার প্রথম দফায় ‘বড় বন্যার’ আশঙ্কা কম। তবে যতটুকু বন্যা হবে, তাতে অন্তত ছয়টি জেলার বেশ কিছু মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। দ্বিতীয় দফায় কী হবে, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই যে বন্য হবে বিষয়টি এমন নয়। বৃষ্টি না হলেও বন্যা হতে পারে। দেখতে হবে আমাদের নদ-নদীর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে পানি বেশি আসছে কিনা? এগুলো যখন উপচে পড়বে, তখনই বন্যা হবে। প্রথম দফায় বড় বন্যার আশঙ্কা একটু কম। কারণটা হচ্ছে, মে মাসে আমাদের এখানে কোনো বৃষ্টি হয়নি। ফলে হাওরসহ নদ-নদীতে পানি ছিল না। এখন যে পানি আসছে, সেটা এখনো উপচে পড়ার মতো হয়নি। গত তিন বছর যেটা হয়েছে, মে মাসে বৃষ্টি হয়ে হাওর, নদ-নদী আগেই ভরে ছিল। ফলে জুন মাসে একটু বৃষ্টি হওয়াতেই এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এবার সেটা হবে না। তবে দ্বিতীয় দফায় কী হবে সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। বড় বন্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।’

এই বিশেষজ্ঞের মতে, ‘আমাদের নদীর চ্যানেলগুলোতে পানি চলাচলের ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে গেছে। পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে, অনেক জায়গায় চর পড়েছে, হাওর অনেক জায়গায় ভরে ফেলা হয়েছে, পূর্ব-পশ্চিমে রাস্তা হয়েছে, এগুলোর ফলে আগে পানি দ্রুত নেমে যেতে পারলেও এখন পানি নেমে যেতে বেশি সময় লাগে। এসব কারণে বর্ষায় বাঁধ তৈরি, নদী খনন করে তলদেশ থেকে ময়লা উত্তোলনের মতো পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া উচিৎ।’

এদিকে কুড়িগ্রামে ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে প্লাবিত এলাকার পরিসর বাড়ছে। দুধকুমার নদের পানি বুধবার রাতে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। যদি বৃহস্পতিবার সকালে আবার কিছুটা নেমেছে। এই এলাকায় প্রতিদিন বাড়ছে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদ-নদী আববাহিকার সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন। ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার অববাহিকার অনেক পরিবারের বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়নি।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে ভেঙে গেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। তীব্র স্রোতে পানি লোকালয়ে ঢুকে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে তেলিয়ানীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর দিয়ে দুধকুমারের পানি লোকালয়ে ঢুকতে থাকে। এক সময় স্রোতের তীব্রতায় ভেঙে যায় প্রায় ২৫০ মিটার বাঁধ। বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে লোকালয়ে ঢুকছে পানি। প্লাবিত করেছে বামনডাঙ্গার তেলিয়ানী, মালিয়ানীসহ প্রায় ১০টি গ্রাম।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বুধবার রাতে দুধকুমার নদের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছিল, কিন্তু সকালে আবার কিছুটা নেমে গেছে। এখানে যে পাঁচটি নদ-নদী রয়েছে, তার সবগুলোতেই পানি বিপৎসীমার খুব কাছাকাছি আছে। আমাদের এখানে মূলত ২৫ কিলোমিটার এলাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে চার কিলোমিটার এলাকা আমরা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছি। তবে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র যে তথ্য আমাদের দিয়েছে, সেখানে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বড় বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই। সতর্কীকরণ কেন্দ্র আমাদের আগাম ১৫ দিনের রিপোর্ট দেয়। তবে স্বাভাবিক বন্যাতেও নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। সেভাবে এখানে কিছু মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন।’

কুড়িগ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বুধবার সন্ধ্যা ৬টার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের ২৪ ঘণ্টায় দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা স্পর্শ করেছে। এই সময়ে ব্রহ্মপুত্রের পানি নুন খাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার এবং চিলমারী পয়েন্টে ৫৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে আগামী দুই তিন দিন এটা একটু বাড়তে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমান বৃষ্টির পরিস্থিতির হিসেব করে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা মনে করছেন যে এই বন্যা খুব বেশি স্থায়ী হবে না। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বলেন, ‘ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে উত্তরাঞ্চলের ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তিস্তা নদীর পানি স্বল্প সময়ের জন্য ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। তবে উত্তরাঞ্চলে মাঝারি বা তীব্র মানের বন্যার আশঙ্কা নেই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ উন্নতির পথে। বৃষ্টিপাত কমে আসায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির পথে। এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পানি বুধবার বিপৎসীমার নিচে অবস্থান করছিল।’

উজানে ব্যারেজ খুলে দেয়ার কারণে কি তিস্তার পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গতিতে বাড়ছে, জানতে চাইলে পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বলেন, ‘তিস্তার দিকে যেটা হয়, উজানে বৃষ্টিপাত বেশি হলে তারা ব্যারেজ খুলে দেয় এবং তখন পানি এদিকে চলে আসে। এই ব্যারেজ তারা কখন খুলে দেবে, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানতে পারি না। এখন তারা ব্যারেজ খুলে দিয়েছে কিনা, তাও আমরা জানি না। আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।’

তবে অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম মনে করেন, ‘ব্যারেজ খুলে দেয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক। একটা নির্দিষ্ট সীমার উপরে পানি উঠলে ব্যারেজ খুলে দিতে হয়। ব্যারেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটাই এমন। আমরাও কিন্তু নির্দিষ্ট সীমার উপরে উঠলে তিস্তা ব্যারেজ খুলে দেই। তা না হলে ব্যারেজ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। আর শুধু ভারত না, চীন, নেপাল, ভুটানের অনেক পানিও এখানে আসে। এখানে একটার সাথে আরেকটা সম্পৃক্ত।’

বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। একইসাথে অভ্যন্তরীণ নদ-নদী করতোয়া, ফুলজোড় ও বড়াল নদীর পানিও বাড়ছে। ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। একইসাথে চরাঞ্চলের ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

সিরাজগঞ্জ পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রণজিত কুমার সরকার জানান, ‘উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টির কারণে কয়েক দিন ধরে যমুনা নদীর পানি বাড়ছে। এ কারণে চরাঞ্চলের নিম্নভূমিগুলো প্লাবিত হতে শুরু করেছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও বাড়ছে। আরো দুই-তিন দিন নদীতে পানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ সূত্র : ডয়চে ভেলে