উপভোগের জন্য বানর নির্যাতন : আন্তর্জাতিক চক্রের মুখোশ উন্মোচন

উপভোগের জন্য বানর নির্যাতন : আন্তর্জাতিক চক্রের মুখোশ উন্মোচন

উপভোগের জন্য বানর নির্যাতন : আন্তর্জাতিক চক্রের মুখোশ উন্মোচন

বিবিসি এক বছর ধরে এক অনুসন্ধান চালিয়ে উদঘাটন করেছে বানরকে নির্যাতন করে আনন্দ উপভোগের বিশ্বব্যাপী এক চক্রের কার্যকলাপ। এই চক্রের তৎপরতা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস জেনেছে ইন্দোনেশিয়ায় লম্বা লেজের ম্যাকাও প্রজাতির বানরকে নির্যাতন করার এবং বানরের বাচ্চাকে হত্যা করার ভিডিও দেখার জন্য আমেরিকা, ব্রিটেন এবং পৃথিবীর অন্যত্র খদ্দেররা কিভাবে ইন্দোনেশিয়দের কাছ থেকে সেসব ভিডিও কিনছে।

এই নির্যাতন চক্রের জন্ম হয় ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে। সেখান থেকে তাদের কার্যকলাপ তারা নিয়ে যায় এনক্রিপ্ট করা যোগাযোগ অ্যাপ টেলিগ্রামে। সেখানে কিছু প্রাইভেট গ্রুপের মধ্যে তাদের কাজ তারা সীমিত রাখে। টেলিগ্রাম, অ্যাপ ব্যবহারকারীদের বার্তার গোপনীয়তা রক্ষা করে।পুলিশ এখন এই ক্রেতাদের ধরার চেষ্টা করছে এবং বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

বিবিসির সাংবাদিকরা ছদ্ম পরিচয়ে টেলিগ্রামের অন্যতম এরকম একটি নির্যাতন গ্রুপের কথোপকথনে যোগ দেন। ওই গ্রুপগুলোতে শত শত মানুষ বানরকে নির্যাতন করার চরম সব আইডিয়া শেয়ার করে এবং ইন্দোনেশিয়া ও এশিয়ার আরও কিছু দেশের মানুষকে অর্থের বিনিময়ে সেসব কাজ করতে বলে।

নিষ্ঠুরতা দেখে আনন্দ উপভোগী এই ব্যক্তিদের লক্ষ্য হলো লম্বা লেজওয়ালা ম্যাকাও প্রজাতির বানরের বাচ্চার লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের ভিডিও বানানো, অনেকসময় এমনকি ছবিতে তাদের মেরে ফেলার দৃশ্য দেখানো।বিবিসি তার অনুসন্ধানে খুঁজে বের করেছে ইন্দোনেশিয়ায় বানর নির্যাতনকারীদের, সেইসঙ্গে আমেরিকায় তাদের তোলা ভিডিও যারা বিতরণ ও বিক্রি করে তাদের। এছাড়াও তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইন প্রয়োগ করার যেসব ব্যবস্থা রয়েছে তাদেরও সাহায্য নিয়েছে বিবিসি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন অন্তত ২০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো হচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত তিনজন নারী যাদের পুলিশ গত বছর গ্রেফতার করেছে। কিন্তু তদন্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। আর আমেরিকার অরিগন অঙ্গরাজ্যের এক ব্যক্তিকে গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে।আমেরিকায় এধরনের ভিডিওর বড় একজন ডিসট্রিবিউটার হলেন মাইক ম্যাককার্টনি। পর্দায় ব্যবহৃত তার নাম “দ্য টর্চার কিং” (নির্যাতনের রাজা)। এ নামেই তিনি বেশি পরিচিত।

বিবিসির সাথে কথা বলতে তিনি রাজি হন এবং যখন টেলিগ্রাম অ্যাপ-এ বানর নির্যাতন দলে তিনি প্রথম যোগ দেন সেই সময়কার কথা আমাদের বলেন।“ওই গ্রুপে ওরা একটা জরিপ চালাচ্ছিল,” ম্যাককার্টনি বলেন। জরিপের বিষয় ছিল: “আপনি কি চান একটা হাতুড়ি ব্যবহার করা হোক? আপনার কি ইচ্ছা নির্যাতনে একটা প্লায়ার ব্যবহার হোক? আপনি কি স্ক্রুড্রাইভারের ব্যবহার চান?” এরপর যে ভিডিও তৈরি করা হয়েছিল “তা আমার এ পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচারের ভিডিও,” তিনি বলেন।

মাইক ম্যাককার্টনি আগে একটি মোটরসাইকেল গ্যাং-এর সদস্য ছিলেন। বানর নির্যাতনের জগতে ঢোকার আগে তিনি বেশ কিছু সময় জেলও খেটেছেন। বানর নির্যাতনে আগ্রহী হবার পর তিনি টেলিগ্রাম প্ল্যাটফর্মে বেশ কয়েকটি গ্রুপ পরিচালনা শুরু করেন। এসব গ্রুপে নিষ্ঠুর পন্থায় অত্যাচারে উৎসাহী ব্যক্তিরা ভিডিও সরবরাহ করতো।“অবৈধ মাদক ব্যবসা থেকে অর্থ উপার্জনের সাথে এর কোন তফাৎ নেই,” তিনি জানান। “ড্রাগের অর্থ আসে অপরাধীদের হাত থেকে, আর এখানে অর্থ আসে তাদের হাত থেকে যাদের হাতে রক্ত লেগে আছে।”

বিবিসি আরো দুজন সন্দেহভাজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (ডিএইচএস) তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে। একজন হলেন স্টেসি স্টোরি, যিনি আলাবামার বাসিন্দা একজন দাদী। নিজের এলাকায় তার পরিচয় “স্যাডিস্টিক” হিসাবে – অর্থাৎ অন্যের কষ্ট দেখে যিনি সুখ পান। আরেকজন হলেন “মি. এপ” নামে পরিচিত চক্রের মূল এক হোতা। নিরাপত্তার কারণে তার আসল নাম আমরা প্রকাশ করতে পারছি না।“এপ” বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে অন্তত চারজন বানরের মৃত্যু এবং আরও বহু সংখ্যক বানরকে অত্যাচার করার জন্য তিনি দায়ী। তিনি “চরম নিষ্ঠুর ভিডিও” তৈরির নির্দেশ দেন বলেও জানান।

স্টেসি স্টোরির ফোন জব্দ করেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। সেখানে তারা প্রায় ১০০টি নির্যাতনের ভিডিও পান। এছাড়াও অত্যন্ত হৃদয়বিদারক অত্যাচারের দৃশ্য সম্বলিত কিছু ভিডিও তৈরির জন্য তিনি অর্থ দিয়েছেন এমন সাক্ষ্যপ্রমাণও তারা পান।পুলিশ সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মিজ স্টোরি এমনকি এমাসের গোড়ার দিক পর্যন্তও এধরনের নির্যাতন গ্রুপে সক্রিয় ছিলেন। বিবিসির সাংবাদিক জানুয়ারি মাসে আলাবামায় তার সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন তার ফোন হ্যাক করা হয়েছে এবং এই অভিযোগ নিয়ে বিস্তারিত কোন মন্তব্য করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

আমেরিকায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ হোমল্যান্ড সিকিউরিটির চলমান তদন্তের পাঁচজন প্রধান টার্গেটের মধ্যে তিনজন হলেন “মি. এপ”, স্টেসি স্টোরি এবং মাইক ম্যাককার্টনি।তাদের বিরুদ্ধে এখনও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়নি। কিন্তু ডিএইচএস-এর সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলায় তারা দোষী প্রমাণিত হলে তাদের সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বা ডিএইচএস-এর তদন্তের যিনি প্রধান - বিশেষ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা পল উলপার্ট, তিনি বলেছেন যেসব আইন প্রয়োগকারী এর সাথে জড়িত আছেন তারা অভিযুক্ত এই অপরাধের প্রকৃতি দেখে গভীরভাবে বিচলিত এবং স্তম্ভিত হয়ে গেছেন।“এধরনের অপরাধ করার জন্য কেউ যে কখনও মানসিকভাবে তৈরি থাকতে পারে তা আমি ভাবতেই পারি না,” তিনি বলেন। “অ্যাটর্নি, জুরি মণ্ডলী, যারাই এ ঘটনার বিবরণ পড়বেন তাদের একই প্রতিক্রিয়া হবে। আমার ধারণা এটা সবাইকে স্তম্ভিত করবে।”

বানরদের ওপর অকথ্য ও নির্মম অত্যাচারের এসব ভিডিও কেনা বা বিতরণের সাথে যারাই জড়িত আছে, “তারা যেন মনে রাখে, তাদের দরজায় কোন না কোন সময়ে আমরা ঠিকই হাজির হব,” জানান পল উলপার্ট। “আপনি কিন্তু পার পাবেন না।”ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ দুজন সন্দেহভাজন নির্যাতনকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। আসেপ ইয়াদি নুরুল হিকমার বিরুদ্ধে পশু নির্যাতন এবং সংরক্ষিত প্রজাতির প্রাণী বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে। তাকে তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।

এম আজিস রাসজানা নামে আরেক ব্যক্তিকে আট মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, যা ইন্দোনেশিয়ায় পশুপাখিদের ওপর নির্যাতনের সবোর্চ্চ সাজা।

টেলিগ্রাম এবং বর্তমানে ফেসবুকে বানরের ওপর অত্যাচারের ভিডিও এখনও খুবই সহজপ্রাপ্য। বিবিসি সম্প্রতি দেখেছে এই দুই প্ল্যাটফর্মে কয়েক ডজন গ্রুপ চরম অত্যাচারের এসব ভিডিও শেয়ার করছে। কোন কোন গ্রুপে সদস্যের সংখ্যা এক হাজারের ওপর।“আমরা দেখেছি এধরনের চরম নিষ্ঠুরতার পুঙ্খানুপুঙ্ক্ষ দৃশ্যের ভিডিও বা কন্টেন্টের সংখ্যা বেড়ে গেছে। যেগুলো আগে লুকানো থাকত, অত প্রকাশ্য ছিল না, এখন সেগুলো ফেসবুকের মত প্ল্যাটফর্মে খোলাখুলিভাবে ছড়ানো হচ্ছে,” বলেন সারা কাইট, যিনি অ্যাকশান ফর প্রাইমেটস নামে একটি পশু বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা।

ফেসবুক বিবিসিকে জানিয়েছে এধরনের নির্যাতনের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব গ্রুপ বা গোষ্ঠির উপস্থিতি তাদের নজরে এসেছে তাদের তারা প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে নিয়েছে। “আমাদের প্ল্যাটফর্মে পশুপাখির ওপর অত্যাচার নির্যাতনকে আমরা উৎসাহ দিই না এবং যখনই এধরনের কন্টেন্ট আমাদের নজরে আসে আমরা সেগুলো সরিয়ে নিই। যেমনটা আমরা এক্ষেত্রে করেছি,” জানান ফেসবুকের একজন মুখপাত্র।

যারা নির্যাতনের ভিডিও তৈরির জন্য অর্থ দেয়, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় তোলার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে ব্রিটেনের আইনকে যুগোপযোগী করার আহ্বান জানান পশু অধিকার কর্মী মিজ কাইট। “কেউ যদি কোন প্রাণীর ওপর শারীরিক নির্যাতন করার নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাউকে অর্থ দেয়, এবং সেই প্রাণীর ওপর কীভাবে অত্যাচার করা হবে তার ফর্দ তৈরি করে দেয়, তাহলে তাকে দায়বদ্ধ করার জন্য আইনকে আরও কঠোর করতে হবে,” তিনি বলেন।ইউটিউব বিবিসিকে এক বিবৃতিতে জানায় যে তাদের প্ল্যাটফর্মে পশু নির্যাতনের জন্য “কোন জায়গা” নেই এবং “নীতি লংঘনকারী কন্টেন্ট দ্রুত সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে তাদের সংস্থা সবসময় সচেষ্ট”।

বিবৃতিতে বলা হয়: “শুধু এই বছরেই আমরা কয়েক লাখ ভিডিও সরিয়ে নিয়েছি এবং সহিংসতা ও আপত্তিকর খোলামেলা কন্টেন্ট পোস্ট করার বিরুদ্ধে আমাদের নীতিমালা লংঘনের দায়ে কয়েক হাজার চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছি।”টেলিগ্রাম জানাচ্ছে, তারা “বাক স্বাধীনতার মত মানবাধিকার এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”। তারা আরও বলেছে যে, তাদের নজরদারি টিমের পক্ষে “ব্যক্তিগত গ্রুপগুলোর ওপর আগাম নজরদারি করা সম্ভব নয়”। সূত্র : বিবিসি