ঢাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ফুটপাতে ঘুমায়

ঢাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ফুটপাতে ঘুমায়

সংগৃহীত

‘দুই বছর আগে বস্তিতে আগুন লাগে। ঘরের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। বাসা ভাড়া ও খাবার খরচ মিটাতেই টানাটানি অবস্থা; ছেলে ও মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে পারি না। তাই ওদের স্কুলে যাওয়া বাদ দিছি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় খুবই কষ্টে চলতে হচ্ছে। শুনেছি বিভিন্ন সময়ে সরকারি কিছু অনুদান আসে; কিন্তু সেসব শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা ভাগ করে নেয়। আমরা কিছুই পাই না। এদের গুলি করে মেরে না ফেললে গরিবদের কাছে কোনো অনুদান পৌঁছবে না।’

কথাগুলো বলছিলেন দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজধানী ঢাকার মিরপুরের চলন্তিকা বস্তির বাসিন্দা আবদুল মান্নান। চলন্তিকা মোড়ের বটতলায় বসে  বলেন, ‘৫০ বছর ধরে বসবাস করছি এ বস্তিতে। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম। দিনমজুর। ১০ বছর বয়সে ঢাকায় এসে এই এলাকায় থাকছি। শিশুশ্রমিক হিসেবে জীবন শুরু, পরে ভ্যান চালাতে শিখেছি। এখন কখনো দিনমজুর ও কখনো ভ্যানচালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছি।’

শুধু আবদুল মান্নান নন, এমন অবস্থা ঢাকার দুই সিটির প্রায় ৩৪ লাখ মানুষের। তারা ঢাকার দুই সিটির জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। জনশুমারি ও জাতীয় গৃহগণনা-২০২২ অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটির জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন।

২০১৫ সালে ঢাকা শহরের নিম্নআয়ের মানুষের ওপর পাওয়ার অ্যান্ড পারটিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্নআয়ের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সরাসরি বস্তি বা বস্তির মতো পরিবেশে বাস করে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ, ২০২২) এ তথ্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ড্যাপের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বেশিরভাগ মানুষের জন্য বাসস্থান এখনো সামর্থ্যরে সীমার বাইরে।

২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। বাংলাদেশের ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগবিষয়ক গবেষণায় এ কথা বলা হয়েছে।

গ্রামপর্যায়ে প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বয়স্কদের তালিকা রয়েছে। এখনো শহরপর্যায়ে এ ধরনের তালিকা করার উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না। নতুন বাজেট উপলক্ষে নগরের দরিদ্রদের তালিকা করার কথা বলেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। বাজেট ঘোষণার আগে কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ) ও কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেও অনুরূপ দাবি জানিয়েছে। কিন্তু বাজেটে এ দাবিনামার প্রতিফলন দেখা যায়নি।

গ্রামপর্যায়ে সরকার দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সহায়তা (ভিজিএফ), কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি করছে; বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীরা সরকারি ভাতা পায়। শহরপর্যায়ে এসব সুবিধা চালুর কোনো পরিকল্পনা নেই। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দাবি জানালেও সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। টিসিবি নগর/শহরপর্যায়ে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করলেও তাতে চরম অব্যবস্থা বিরাজমান। যাদের প্রয়োজন তারা সেসব পাচ্ছে না। অপেক্ষাকৃত সচ্ছলরা এ সুবিধা নিচ্ছে। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী টিসিবি থেকে দেওয়া নির্ধারিত পরিমাণ পণ্যও কিনতে পারছে না। যা রোজগার হয় তা নিয়ে একত্রে এত পরিমাণ মালামাল সবাই কিনতে পারে না। আর টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে সবসময় মালামালও পাওয়া যায় না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকার মিরপুরের চলন্তিকা বস্তির ছোট ছোট ঘরে বসবাস হাজারো মানুষের। সরকারি জমিতে প্রভাবশালী মহল গড়ে তুলেছে এসব বস্তিঘর। ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া এসব ঘরের। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বস্তির নির্মাতারা। তীব্র গরমে বস্তির মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। শিশুদের মধ্যে রয়েছে অপুষ্টির ছাপ। তাদের শরীরের হাড় গোনা যায়।

বস্তির প্রবেশমুখে দেখা গেল, একজন বৃদ্ধ বাদাম বিক্রেতাকে দুই টাকার বাদাম দিতে বলছেন। বিক্রেতা তাকে বলছেন, এখন দুই টাকার বাদাম হয় না। ধমকের সুরে ওই বৃদ্ধ বাদাম বিক্রেতাকে বললেন, এখন আর কাজ করতে পারি না। ছেলেদের ওপর ভর করে জীবন চলছে। নিরুত্তর বাদাম বিক্রেতা কয়েকটা বাদাম তার হাতে গুঁজে দিলেন। কাছে গিয়ে বৃদ্ধের কাছে জানতে চাই, ‘কেমন আছেন?’ পরিচয় জেনে তিনি গল্প শুরু করেন। জানালেন, তার নাম মজনু ভাণ্ডারী। ৪০ বছর ধরে ওই এলাকায় বাস করেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের মজনুর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, শিক্ষা না থাকায় সনদও বুঝে নিতে পারেননি। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের বাবা। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের আলাদা সংসার। এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং তিনি ও তার স্ত্রী মিলে তাদের সংসার। জীবনের পড়ন্ত বেলায় মজনু ভাণ্ডারীর ভীষণ শঙ্কা। সন্তানরা দয়া করলে ঢাকায় থাকতে পারবেন, নইলে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। বাবার কিছু সম্পত্তি থাকলেও তা অন্য স্বজনদের দখলে। এখন গ্রামে গেলে স্বজনরা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। দীর্ঘ বস্তিজীবনে সরকারের কোনো সুবিধা পাননি। গায়ে খেটে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। কিছুদিন পরপর আগুনের ঘটনা তাদের জীবন আরও কষ্টের মধ্যে ফেলে দেয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পর্যন্ত সড়কের ফুটপাতে বাস্তুহারা মানুষ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাতে ঘুমানোর মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ভবঘুরে বাস্তুহীন, নদী ভেঙে সব হারানো, স্বজনদের প্রতি অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে আসা মানুষ। তাদের জীবনের গল্প বিচিত্র।

গত ১২ জুন কথা হয় হাইকোর্টের বটতলায় থাকা আকলিমার সঙ্গে। তার বাবা-মাও সেখানে থাকত। কৈশোরে আকলিমাকে বিয়ে দেওয়া হয় কামরাঙ্গীরচরের এক যুবকের সঙ্গে। সে সংসারে তার এক কন্যাসন্তান হয়। নানা টানাপড়েনে আকলিমার সংসার করা হয়নি। এদিকে তার বাবা-মার সংসার ভেঙে গেছে। তারা এখন আর হাইকোর্ট এলাকায় থাকেন না। শ্বশুরবাড়ি থেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী আকলিমা শিশুকন্যাকে নিয়ে আবারও এসে উঠেছেন হাইকোর্টের বটতলায়। হাইকোর্ট-মাজারের ভক্তদের দেওয়া খাবার খেয়ে এবং মানুষের কাছে হাত পেতে কোনোরকম জীবন কাটাচ্ছেন। ঝড়, বৃষ্টি, তাপপ্রবাহ সয়ে বয়ে চলছে তাদের জীবন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর, অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘নগরের দরিদ্র মানুষরা গ্রামের দরিদ্রদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আটের দশকে সরকার অনুধাবন করে, গ্রাম থেকে দরিদ্র মানুষরা ঢাকায় এসে বস্তি গড়ে বাস করছে। তারা শহরের পরিবেশ নোংরা করছে। যখন গ্রামপর্যায়ে সরকার দরিদ্রদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া শুরু করে, তখন দরিদ্রের নগরবিমুখ করার চিন্তা থেকে শহরের দরিদ্রদের সে সুবিধার বাইরে রাখা হয়। বস্তিপর্যায়ে এনজিওদের কিছু কাজ রয়েছে। সেখান থেকে স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও শিক্ষাসেবা পায় বস্তিবাসী। তবে এনজিওদের সহায়তা যথেষ্ট নয়।’

তিনি বলেন, ‘দেশে নগরায়ণ বাড়ছে। ধাপে ধাপে নগরের আওতা বাড়বে। সরকারের উচিত আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা; গ্রামের দরিদ্রদের সুবিধাগুলো শহরের দরিদ্রদেরও দিতে হবে। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রভৃতি সুবিধা শহরের দরিদ্রদেরও দিতে হবে।’

জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, ‘গ্রামপর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুবিধা বেশি। শহরপর্যায়ে কম। সরকার ভবিষ্যতে নগরের দরিদ্রদের জন্যও গ্রামীণ দরিদ্রদের মতো সুবিধার ব্যবস্থা করবে। সরকারের পরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।’ সূত্র: দেশ রূপান্তর