গুগল ও ফেসবুকের সাথে যুদ্ধে জড়াচ্ছে কানাডা, হারের সম্ভাবনাই বেশি

গুগল ও ফেসবুকের সাথে যুদ্ধে জড়াচ্ছে কানাডা, হারের সম্ভাবনাই বেশি

গুগল ও ফেসবুকের সাথে যুদ্ধে জড়াচ্ছে কানাডা, হারের সম্ভাবনাই বেশি

মেটা - ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের মালিকানা প্রতিষ্ঠান- এবং গুগল জানিয়েছে কানাডায় তাদের প্লাটফর্মে তারা স্থানীয় সংবাদ ব্লক করবে। সংবাদ মাধ্যমগুলোকে তাদের কনটেন্টের জন্য পয়সা দিতে হবে – কানাডায় এমন একটি আইন পাশের পর এই দুই প্রযুক্তি জায়ান্ট এই হুমকি দিল।

কী দাঁড়াবে পরিস্থিতি এখন?

কানাডার কিবেক অঙ্গরাজ্যের ফরাসী ভাষার মিডিয়া হাউজ লা প্রেসের প্রেসিডেন্ট পিয়ের এলিয়ট লোভাসিওর বলেন ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের সাথে টাকা-পয়সা নিয়ে চুক্তির জন্য তিনি বছরের পর বছর চেষ্টা করছেন।কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন তার প্রতিষ্ঠানের ২২০ জন কর্মী জান-প্রাণ দিয়ে যে কনটেন্ট তৈরি করছে তা দিয়ে এইসব প্রযুক্তি কোম্পানি প্রচুর পয়সা বানাচ্ছে।“কিন্তু ন্যায্য পয়সা চাইলে তারা মুখের ওপর না বলে দিচ্ছে,” বিবিসিকে তিনি বলেন।

তিনি আশা করছিলেন অনলাইন নিউজ অ্যাক্ট নামের নতুন আইনটি এই অবস্থা বদলে দেবে। ভেবেছিলেন যে মিডিয়ার তৈরি সংবাদ ও অন্যান্য কনটেন্ট প্রচারের জন্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এখন পয়সা দেবে যা তারা ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারবেন।

গুগল এবং মেটাকে লক্ষ্য করে তৈরি এই আইনে বলা হয়েছে এসব প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে এখন থেকে টাকা-পয়সা দেওয়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সাথে বোঝাপড়া করে চুক্তি করতে হবে। যদি দুই পক্ষ কোনো চুক্তিতে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয় - তাহলে দেশের গণমাধ্যম বিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের মধ্যস্থতায় আপোষ-মীমাংসা করতে দুপক্ষকে বাধ্য করতে পারবে।

পার্লামেন্টের বাজেটের ওপর নজরদারি করে এমন একটি নিরপেক্ষ সংস্থার হিসাবে এই আইনের ফলে কানাডার সংবাদমাধ্যমগুলো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বছরে ৩০ কোটি কানাডীয় ডলার (২২.৬ কোটি মার্কিন ডলার) আয় করবে, যা তাদের সংবাদ সংগ্রহ এবং তৈরির খরচের ৩০ শতাংশ মেটাবে।কিন্তু সেই আশাবাদের ওপর ছাই ঢেলে দিচ্ছে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো।

তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে এমন আইন তারা মানবে না, বরং কানাডার মিডিয়াগুলো সংবাদের লিংক তাদের প্লাটফর্মগুলোতে শেয়ার করলে সেগুলো ব্লক করে দেওয়া হবে।মেটা, যারা প্রথম থেকেই এমন আইনের বিরোধিতা করছিল- বলেছে আগামী কয়েক মাসে তাদের প্লাটফর্মে কানাডার নিউজ সাইটগুলো ব্লক করা শুরু করা হবে।

ইন্টারনেট জায়ান্ট গুগল ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়াতে সংবাদ-মাধ্যমগুলোর সাথে টাকা-পয়সা দেওয়ার চুক্তি করেছে, এবং তারা বলেছে তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরণের চুক্তির জন্য প্রস্তুত।

সংবাদ ব্লকের হুমকি

তবে কানাডার নতুন এই আইন সম্পর্কে এ সপ্তাহে গুগল হুমকি দিয়েছে যে ছ'মাসের মধ্যে আইনটি যখন কার্যকর করা হবে, তখন তারা তাদের সার্চ ইঞ্জিন থেকে কানাডা থেকে আপলোড করা সংবাদের সমস্ত লিংক ব্লক করে দেবে।গুগল জানিয়েছে বর্তমানে কানাডার দেড়শরও বেশি সংবাদ মাধ্যমের সাথে তাদের চুক্তি রয়েছে, এবং দাবি করেছে গুগল থেকে পাওয়া ট্রাফিকের কারণে এসব সংবাদ সাইটগুলো বছরে ২৫ কোটি কানাডীয় ডলার আয় করছে।

“আমরা আরও করতে চাই,” বলেছে গুগল, “কিন্তু ওয়েব এবং সার্চ ইঞ্জিনগুলো বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে তার বাইরে গিয়ে আমরা কিছু করতে পারবোনা। কারণ তা টেকসই হবেনা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।“গত মাসে এই আইন পাশের আগে প্রধানমন্ত্রী জান্টিন ট্রুডো সংবাদের লিংক ব্লকের এসব হুমকি অগ্রাহ্য করেন।

লা প্রেসের পিয়ের-এলিয়ট লোভাসিওর বলেন, “টাকা দেওয়ার বদলে স্থানীয় সংবাদ সাইটগুলোতে কানাডীয়দের ঢোকা বন্ধ করে দেয়ার যে হুমকি দিচ্ছে এসব ইন্টারনেট জায়ান্ট সেটাই প্রধান সমস্যা। তারা এখন রীতিমত হুমকি-ধমকির পথ নিয়েছে। কিন্তু তাদের এই কৌশল কাজ করবে না।“প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বলছে জবরদস্তি করে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মিডিয়াগুলোকে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু মি. লোভাসিওর বলেন, মিডিয়াগুলো কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য চাইছে না।

“আমরা ন্যায্য একটি ব্যবসায়িক চুক্তির জন্য দেন-দরবারের সুযোগ চাইছি,” তিনি বলেন। “একটা কারণেই তারা এটা চায়না কারণ বাজারে তাদের মনোপলি বা একাধিপত্য।“কানাডার সরকার ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর এই বিরোধ কোন দিকে মোড় নেয় বিশ্বের বহু দেশেরই নজর থাকবে - কারণ ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত এবং ব্রিটেনসহ অনেক দেশ এ ধরণের আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে।

যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া নিয়ে টানা-হেঁচড়া চলছে তা এসব প্রযুক্তি কোম্পানির শত শত কোটি ডলার আয়ের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ কিন্তু সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ - বলেন মনোপলি বিরোধী গবেষণা সংস্থা ওপেন মার্কেটস ইনস্টিটিউটের অন্তর্গত সেন্টার ফর জার্নালিজম অ্যান্ড লিবার্টির পরিচালক কর্টনি র‍্যাডশ।“সার বিশ্বেই ঐক্যমত্য তৈরি হচ্ছে যে সংবাদ ব্যবহারের জন্য গুগল এবং ফেসবুকের উচিৎ মিডিয়াকে পয়সা দেওয়া,” তিনি বলেন। “মানুষের বোঝা উচিৎ গণতন্ত্রের মৌলিক স্তম্ভ এই সাংবাদিকতাকে রক্ষা করতে হবে।“

অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা কী ছিল

এ ব্যাপারে ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়া যে আইন করেছে কানাডার আইনটি তার ভিত্তিতেই তৈরি। অস্ট্রেলিয়াতেও তখন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো একইরকম আপত্তি তুলেছিল। মেটা তাদের প্লাটফর্মে অস্ট্রেলিয়ান সংবাদের সমস্ত লিংক ব্লক করে দিয়েছিল।

তারপর, আইনে কিছু পরিবর্তন করার পর গুগল ও মেটা অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া হাউজগুলোর সাথে ৩০টিরও বেশি চুক্তি করে যার সর্বমোট মূল্য দাঁড়ায় ১৩০ মিলিয়ন ডলার। ব্যবসায় প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়ান যে প্রতিষ্ঠান তার তৎকালীন প্রধান রডনি সিমস্‌ এসব তথ্য দিয়েছেন।মি. সিমস্‌ মনে করেন কানাডার ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো একই আচরণ করবে।

সংবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে ফেসবুক

তবে মেটার প্লাটফর্ম থেকে এখন সংবাদ সরিয়ে দিতে ইচ্ছুক এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ। শুধু ব্যক্তিগতভাবে তৈরি কনটেন্টকে জায়গা দিতেই তিনি আগ্রহী।ফলে, অনেকে সাবধান করছেন অস্ট্রেলিয়াতে যে বোঝাপড়া হয়েছে কানাডাতে তেমনটা নাও হতে পারে।

কানাডার শীর্ষ একটি মিডিয়া হাউজ গ্লোব এবং মেইল - যাদের সাথে গুগল, মেটা, অ্যাপল এবং আরো কটি কোম্পানির লাইসেন্স চুক্তি রয়েছে - তার প্রধান নির্বাহী ফিলিপ ক্রলি বলেন, নতুন যেসব সার্চ প্রযুক্তি আসছে তা গুগল বা মেটার আধিপত্য ভাঙতে পারছেনা। যেমন, চ্যাট-জিপিটির মত চ্যাটবটগুলো শুধু ব্যবহারকারীদের করা প্রশ্নের উত্তর হাজির করতে পারে, কিন্তু কোনো লিংক দিতে পারছে না।ফলে, তিনি মনে করেন, খবরের জন্য টাকা-পয়সা দেওয়া নিয়ে দেনদরবারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ তৈরি কঠিন হবে। তারা বরঞ্চ তাদের অবস্থান আগের চেয়ে শক্ত করতে পারে।

“সময় বদলে গেছে,” বলেন মি. ক্রলি যদিও তিনি কানাডায় তৈরি আইনটির সমর্থক। “সুতরাং আমি মনে করি অস্ট্রেলিয়ায় যে মডেল কাজ করেছে, কানাডায় তা হয়তো করবে না। তখন সময় ছিল একরকম, এখন আরেক রকম।“গুগল এবং মেটা বলছে অস্ট্রেলিয়ার আইন আর কানাডায় আইনে মৌলিক কিছু তফাৎ আছে। অস্ট্রেলিয়াতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সমস্ত মিডিয়ার সাথে চুক্তি করতে বাধ্য নয়। কিন্তু কানাডার আইনে সেই সুযোগ নেই।

গুগল জানিয়েছে আইনটি পাশের আগে তারা সরকারের সাথে তাদের উদ্বেগ-আপত্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তাদের পাত্তা দেওয়া হয়নি।নতুন এই আইনের সমালোচক এবং প্রযুক্তি আইনের সুপরিচিত একজন বিশেষজ্ঞ মাইকেল গেইস্ট বলেন মেটার ব্যবসা কৌশলের যে পরিবর্তন হচ্ছে তা কানাডার সরকার ধরতে পারেনি।

মেটা বলছে ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সংবাদের জন্য তাদের প্লাটফর্মে আসা প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সংখ্যা ৪৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। এক জরিপে তারা দেখেছে ব্যবহারকারীরা তাদের প্লাটফর্মে কম খবর দেখতে চায়।“সরকার কেন এসব বুঝতে পারছে না?” বলেন মি. গেইস্ট। “ফেসবুক ভাঁওতা দিচ্ছেনা ... তারা আসলেই আর সংবাদ নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইছে না।“

গুগল অবশ্য বলেছে তারা আইনি এসব প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। তবে তাতে সময় যাবে, এবং পরিণতিতে বহু সংবাদকক্ষের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়বে।গ্লোব এবং মেইলের আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ এখনও তাদের সাবস্ক্রাইবার বা নিয়মিত পাঠকদের কাছ থেকে আসে। গুগল ট্রাফিক থেকে তাদের আয় হয় ৩০ শতাংশ।

কানাডার ফরাসী ভাষার প্রধান একটি সংবাদপত্র ল্য দেভোয়া’র আয়ের ৪০ শতাংশ আসে গুগল ট্রাফিক থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ আসে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে।।কানাডার বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার সাথে মেটার যেসব চুক্তি রয়েছে সেগুলো এখন তারা বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে । তার অর্থ, বিভিন্ন মিডিয়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হারাবে।

মি. লোভাসিউর স্বীকার করেন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সত্যিই যদি ব্ল্যাক আউটের পথ নেয়, তাহলে তার লা প্রেসের ওপর চাপ তৈরি হবে। তবে তিনি বলেন, এখনও প্রতিদিন তার ডিজিটাল সাইটে পাঠকের সংখ্যা ১৪ লাখ এবং তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন।“আমরা যখন পত্রিকাটি কাগজে ছাপা বন্ধ করে দিলাম, তখন বিজ্ঞাপন কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখন আবার বাড়ছে,” তিনি বলেন। “আমরা তখনও সংকট সামাল দিয়েছি, এবং আমি নিশ্চিত ভবিষ্যতেও পারবো।“

সূত্র : বিবিসি