ইসলামে পরিবার প্রথার গুরুত্ব

ইসলামে পরিবার প্রথার গুরুত্ব

প্রতীকী ছবি।

ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সুস্থতার জন্য নৈতিক গুণসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন বেশি। এ ক্ষেত্রে যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলার জন্য সুসন্তান প্রতিপালনে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আমরা জানি, পরিবার মানবজাতির প্রাচীনতম প্রথা ও প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের নানা পরিবর্তনের ফলে পরিবার ব্যবস্থা নানা হুমকির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও মানবসমাজের সুস্থতা, সুশিক্ষার বিস্তার ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য পরিবারের ভূমিকা এখনো আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর। তাই সুস্থ ও সুখী পরিবার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামি সমাজব্যবস্থার পরিবারবিষয়ক মূল্যবোধ, শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা, বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীদের নানা অভিমত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, অতি আধুনিকায়নের প্রভাবে সমাজ ও পরিবারগুলোতেও নানা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। যেমন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে সাইবার জগৎ এখন আধুনিকতার বাহন হিসেবে পরিবারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনেক দেরিতে বা বেশি বয়সে বিয়ের প্রবণতা বাড়ছে। বাড়ছে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রকামিতা এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক নানা প্রত্যাশার ধরন! বাড়ছে তালাক ও বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক। আর এসবের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ইন্টারনেট ও সাইবার জগতের!

ইসলাম মনে করে, ব্যক্তিকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগানো জরুরি। তাই পরিবারের সদস্যদের আরও বেশি সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সাইবার মিডিয়াগুলোর নানা নেতিবাচক দিক উপেক্ষা করে এসব মিডিয়াকে আধুনিক জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে মেনে নিয়েই স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন অব্যাহত রাখার কৌশল রপ্ত করতে হবে পরিবারের সদস্যদের। অতীতের পরিবারগুলোর মতোই পরিবারে বজায় রাখতে হবে প্রেম-প্রীতি, সহনশীলতা, সুশিক্ষা, সুসন্তান গড়ার দৃঢ়-সংকল্প, নানা সংকট মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতা, ত্যাগ ও ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি।

এটা অত্যন্ত আশার কথা যে, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশে এখনো টিকে আছে পরিবার প্রথা। সেই সঙ্গে বর্তমান সমাজে এখন পরিবার গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসহ নানা ইস্যুতে নারীর মতামত বেশ গুরুত্ব পায়। পরিবারগুলোতে এখন নারী-পুরুষের ভূমিকা অনেকটাই অংশীদারত্বমূলক এবং পুরুষের বলদর্পিতার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা ও অধিকারই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

আমাদের দম্পতিরা এখনো সন্তান নিচ্ছেন এবং সন্তানের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাবা-মায়েরা এখনো কম বয়স্ক ও বয়স্ক সন্তানকে সহায়তা দিয়ে থাকেন বেশ জোরালোভাবে, তাদের সময় দিচ্ছেন এবং তাদের পারস্পরিক আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রয়েছে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের কারণেই পরিবারগুলো টিকে আছে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে। ইসলাম পরিবারব্যবস্থা রক্ষা করাকে সামাজিক সুস্থতার নিয়ামক হিসেবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।

ইসলাম পরিবারকে কেবল বৈষয়িক সুখের মাধ্যম হিসেবে দেখে না, আধ্যাত্মিক প্রশান্তির জন্যও গুরুত্ব দেয়। ইসলাম পরিবারের সদস্যদের অধিকার রক্ষা ও তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। স্বামী ও স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও অধিকারের সীমানাগুলোও তুলে ধরেছে পবিত্র কোরআন। পরিবার যাতে টিকে থাকে সে জন্য বাবা-মা যখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েন তখনো দাদা-দাদি হিসেবে সক্রিয় ও সচেষ্ট থাকেন।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো আধুনিকতার অনেক কাঠামো পশ্চিমা সমাজের পরিবারগুলোতে নানা সংকট সৃষ্টি করছে। সেখানে সুস্থ জীবনের নানা মূল্যবোধ উপেক্ষিত। ফলে পরিবারগুলো ধসে পড়ছে এবং সেখানে দেখা দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা, হতাশা ও নৈরাজ্য। ফলে পশ্চিমা সমাজবিদরা আবারও পরিবার প্রথাকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিচ্ছেন। একমাত্র ইমান বা বিশ্বাসের ছায়াতলেই পারিবারিক মূল্যবোধগুলো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

পরিবার প্রথা টিকিয়ে রাখা ছাড়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির চাকাকে অগ্রগতির দিকে নেওয়া সম্ভব নয় এবং সম্ভব নয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুফলকে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া। ইমাম গাজালি (রহ.)-এর ভাষায়, ‘শরীরের কোষগুলো রোগাক্রান্ত হলে গোটা শরীর যেমন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তেমনি পরিবারগুলো সুস্থ না হলে গোটা সমাজই অসুস্থ হয়ে পড়ে।’ সুতরাং ব্যক্তিকে যোগ্য নাগরিক ও সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগানো জরুরি। তাই দম্পতিদের উন্নতির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সঠিক ও পরিপূর্ণ মানবীয় গুণগুলো বিকশিত হয়। তারা যদি যোগ্য ও ইমানদার নাগরিক গড়ে তুলতে না পারেন তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের সমাজ আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে উঠবে না। এ অবস্থায় উচ্চতর লক্ষ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলো অর্জনে ব্যর্থ হবে নতুন প্রজন্ম।