বাদুড় দিয়ে মহামারীর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা হচ্ছে যেভাবে

বাদুড় দিয়ে মহামারীর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা হচ্ছে যেভাবে

বাদুড় দিয়ে মহামারীর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা হচ্ছে যেভাবে

ঘানার রাজধানী আক্রার চিড়িয়াখানায় সন্ধ্যাবেলাকে ভুতুড়ে সময় হিসাবে দেখা হয়। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে বড় একটি খাঁচার মত ঘেরা জায়গায় আটকে রাখা খড়ের মত রঙের ফল-খেকো বাদুড়গুলোর নড়াচড়া শুরু হয়। আর এই সময়টাতেই এগুলোর শরীর লুকিয়ে থাকা প্যাথোজেন বা রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের উপস্থিতি পরীক্ষার উপযুক্ত সময়।আক্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি স্কুলের একদল বিজ্ঞানী সেই সন্ধ্যায় চিড়িয়াখানার ঐ খাঁচায় হাজির হয়েছেন এসব বাদুড়ের বিষ্ঠা সংগ্রহের জন্য।

ভবিষ্যতে কোভিডের মত কোনো বড় মহামারী আগেভাগে আঁচ করার উপায় খুঁজতে যে আন্তর্জাতিক একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে ঘানার এই বিজ্ঞানীরা তারই অংশ হিসাবে কাজ করছেন।ঘানায় এখন তীব্র গরম, কিন্তু তারই মধ্যে পুরো শরীর পিপিইতে ঢেকে বাদুড়ের খাঁচায় ঢুকে মেঝেতে একটি সাদা তারপুলিন বিছিয়ে দিলেন।

বিজ্ঞানীদের দলের নেতা ড. রিচার্ড সু-আয়ার অনেক বছর ধরে বাদুড় নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, খাঁচায় ঢোকার আগে পিপিই পরা জরুরী কারণ “তা নাহলে আপনি নিজে সংক্রমিত হতে পারেন, আবার আপনার কাছ থেকে বাদুড়গুলো সংক্রমিত হতে পারে।“কিন্তু বাদুড় নিয়ে এত গবেষণার পরও বিশ্বের একমাত্র উড়ে বেড়ানো স্তন্যপায়ী এই প্রাণীর অসামান্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে রহস্যের কিনারা এখনো মেলেনি। বাদুড় বহু বিপজ্জনক ভাইরাসের বাহন, কিন্তু সেগুলোতে তারা নিজেরা অসুস্থ হয়না।

ব্যাট ওয়ান-হেলথ

ব্যাট ওয়ান-হেলথ নামে আন্তর্জাতিক এক প্রকল্পে ঘানার সাথে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়ার এবং আরও কিছু দেশ কাজ করছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো এটা খুঁজে দেখা যে কেন প্যাথোজেন বা রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব এক প্রজাতির প্রাণী থেকে অন্য প্রজাতির মধ্যে প্রবেশ করে, এবং কীভাবে এই প্রক্রিয়া ঠেকানো যায়।কোভিড প্যানডেমিকের অভিজ্ঞতার আলোকে বাদুড় বাহিত রোগজীবাণুকে এই গবেষণা প্রকল্পে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ড. সু-আয়ার বললেন তারা বাদুড়ের শরীরে প্যারামিক্সো-ভাইরাস এবং করোনাভাইরাসের উপস্থিতি খুঁজে দেখছেন। মানুষের শরীরে এসব ভাইরাস ঢুকলে মাম্পস, হাম এবং শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ হতে পারে।কিন্তু, তিনি বলেন, বাদুড় এসব জীবাণুতে আক্রান্ত হলেও অসুস্থ হয়না। “আমরা দেখতে চাই কেন বাদুড়ের ক্ষেত্রে এমনটি হয়।“তিনি বলেন, জঙ্গলের বাদুড় নিয়ে গবেষণা করার সময় তারা এগুলোর মধ্যে কোভিড-১৯ খুঁজে পাননি।

তবে আজ তারা বাদুড়ের বিষ্ঠায় সুপার-বাগ রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখছেন। বাদুড়গুলোকে তারা আমের মত দেখতে প-প নামের স্থানীয় একটি ফল খাইয়েছেন। ফলে সাদা তারপুলিনের ওপর যে বিষ্ঠা বাদুড়গুলো ত্যাগ করেছে তা দেখতে প-প’র মতই অনেকটা কমলা রংয়ের। বিজ্ঞানীরা সেগুলো তুলো জড়ানো কাঠি দিয়ে তুলে টেস্ট-টিউবের মধ্যে রাখলেন।আন্তর্জাতিক এই গবেষণা প্রকল্পে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখছে।বাদুড় এবং মহামারী রোগের জীবাণু নিয়ে এ ধরণের গবেষণা বিশ্বে এটাই প্রথম, তবে বিষয়টি এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে অনেকটাই অস্পষ্ট, অজানা।

ঘানার এই বিজ্ঞানীরা এটাও খুঁজে দেখছেন বাদুড়ের বিষ্ঠায় এমন কোনো ব্যাকটেরিয়া রয়েছে কিনা যা অ্যাান্টিবায়েটিক দিয়ে ধ্বংস করা যায়না।ড. সু-আয়ার বলছেন: “আমরা যদি তেমন কোনো আ্যান্টিবায়েটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পাই তাহলে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে চেষ্টা করবো কোন কোন অ্যান্টিাবায়েটিক সেগুলোর ক্ষেত্রে অকার্যকর। তখন আমরা ঐ ব্যাকটেরিয়াগুলো থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জ্বিনগুলো সরিয়ে ফেলবো।“

 ‘বাদুরকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে

ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাদুড় নিয়ে শুধু এই একটি গবেষণাই হচ্ছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বোটানিক্যাল উদ্যানে ড. কোফি আমপোনসা-মেনশা উঁচু করে সবুজ রংয়ের কিছু নেট বসিয়েছেন। অনেকটা ব্যাডমিন্টন নেটের মতো দেখতে।উদ্দেশ্য, এসব জালে কিছু বাদুড় আটকা পড়বে যেগুলোর ওপর তিনি গবেষণা চালাবেন। কাজ হয়ে গেলে সেগুলোকে তিনি আবারো ছেড়ে দেবেন। যেভাবে মানুষ দিনকে দিন বাদুড়ের প্রাকৃতিক আবাসস্থলের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে তা নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি উদ্বিগ্ন।

তিনি বলে ঘানায় বন ধ্বংস হচ্ছে দ্রুততর গতিতে। খনির প্রসারের কারণে বাদুড়ের বহু পুরনো প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংস হচ্ছে। “আমাদের এখন এমন কিছু রোগ হচ্ছে তা আগে কখনো হয়নি। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের নিজেদের দোষ ঢাকতে আমরা বাদুড়কে বলির পাঁঠা করছি।““আমরা বাদুড়ের ডেরায় গিয়ে ঢুকছি এবং প্রতিবেশের ভারসাম্যের বারোটা বাজাচ্ছি। ফলে বাদুড়ের আর মানুষের মধ্যে সংস্পর্শ বাড়ছে, এবং সম্ভবত সে কারণে নতুন কিছু রোগ দেখা দিচ্ছে।“

বন্যপশুর মাংসের বিপজ্জনক বাজার

এ প্রসঙ্গে ঘানাসহ আফ্রিকার অনেক দেশে প্রচলিত বুশমিট (নানা ধরণের বন্যপশুর মাংস) খাওয়ার সংস্কৃতির কথা ওঠে।

আক্রার পরিত্যক্ত একটি রেললাইনের পাশে বুশমিটের বাজারে প্রায় সবধরনের বন্যপশুর মাংস বিক্রি হয়। গভীর জঙ্গলের ভেতর এসব পশু শিকার করা হয়। এখানে বাদুড় এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসে মানুষ। এক পশু আরেক পশুর সংস্পর্শে আসে। তৈরি হয় অজানা জীবাণুতে সংক্রমণের সম্ভাবনা, এবং সেইসাথে অজানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।অনেক নারী যারা এই বাজারে কাজ করেন তারা উন্মুক্ত স্থানে রান্না করেন। ফলে পুরো এলাকায় প্রচণ্ড গরম।বাজারের একটি কোনায় একটি দোকানে দেখলাম একটি সসপ্যানের ঢাকনা ভর্তি শুকনো কুঁচকানো খড়ের রংয়ের মরা বাদুড়। ড. আমপোনসা-মেনশা বললেন আগুনে ঝলসে বাদুড়গুলোর পশম ছাড়ানো হয়েছে।

কোভিড প্যানডেমিকের পর অনেক বিশেষজ্ঞ এ ধরণের পশুর বাজার বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও ড. আমপোনসা-মেনশা বললেন তিনি নিজে বাদুড়ের মাংস কখনই খাবেননা কিন্তু পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা নিয়েও তার অস্বস্তি রয়েছে।তিনি বলেন, বুশমিট খাওয়ার প্রচলন এবং এর ব্যবসা হাজার হাজার বছরের পুরনো এবং এটি সেদেশের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। অনেকে গরু বা মুরগির মাংসের বদলে বুশমিট পছন্দ করে।

“এই ব্যবসার সাথে মূলত নারীরা জড়িত এবং এটি ছাড়া অন্য কোনো জীবিকা তারা জানেনা। কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটি চলছে। তার দাদি বা মাও হয়তো এই ব্যবসাই করতো,” তিনি বলেন।“সুতরাং এসব জটিল বিষয়গুলো বিবেচনা না করে বুশমিটের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করলে সমাজে তার প্রভাব গুরুতর হতে পারে।“

ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগুচি ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল রিসার্চের কঠোর নিরাপত্তায় মোড়া অত্যাধুনিক ল্যাবে আক্রা চিড়িয়াখানা থেকে সংগৃহীত বাদুড়ের বিষ্ঠা পরীক্ষা করা হবে। তদারকি করবেন ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কোফি বনি।তিনি বলেন, এই ল্যাবে বাতাসের চাপ এমনভাবে রাখা হয় যাতে কোনো প্যাথোজেন এখান থেকে বাইরে বেরুতে না পারে।কোভিড প্যানডেমিকের পর ভবিষ্যতে মহামারি প্রতিরোধে যে জোর চেষ্টা বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তার কারণে অধ্যাপক বনি এবং তার দল এখন খুবই ব্যস্ত।

ব্যাট ওয়ান-হেলথ প্রকল্পের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন: “পশু এবং মানুষ নিয়ে গবেষণার সমন্বয় এখন খুবই দরকার। আমাদেরকে এখন খুবই দ্রুত কিছু ভাইরাস শনাক্ত করতে হবে যাতে সেগুলোর বিস্তৃতি ঠেকানো সম্ভব।““তা নাহলে মানুষের শরীরে ভাইরাস একবার ঢুকে পড়লে, এটি ছড়াতে থাকে এবং ভাইরাস ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে নতুন রূপ নিতে পারে। আর নতুন রূপ নিলে তা আরো শক্ত রোগ সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং এমন একটি ব্যবস্থা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে এসব ভাইরাস যাতে দ্রুত শনাক্ত করা যায়।“

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ এবং জীবজন্তুর নৈকট্য বাড়বে। কারণ, সুপেয় পানির মত সম্পদের টান পড়লে বা সূর্যের তাপ থেকে নিজেদের আড়াল করতে মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে সংস্পর্শ বাড়বে।বাদুড় নিয়ে আগে থেকেই শত শত কোটি ডলারের গবেষণা হচ্ছে। অন্যতম কারণ - এই প্রাণীর শরীরে রোগ প্রতিরোধের অসামান্য ক্ষমতা। সেইসাথে একটানা যতটা পথ তারা অতিক্রম করতে পারে তাও বিস্ময়কর ।বাদুড়দের ব্যাপারে আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেলে – যে চেষ্টা ঘানায় করা হচ্ছে – ভবিষ্যতে পৃথিবীর মঙ্গলে তা বড় ভূমিকা রাখবে।

সূত্র : বিবিসি