আলুর বাজারে খেলছে আড়তদার

আলুর বাজারে খেলছে আড়তদার

ছবিঃ সংগৃহীত।

জয়পুরহাট জেলায় চলতি বছর আলুর চাষ হয়েছে ৩৮ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার ৭৬০ টন। অথচ জেলায় চাহিদা মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টন। মৌসুম শেষে জেলার ১৯টি হিমাগারে ব্যবসায়ী ও কৃষকরা এবার আলু সংরক্ষণ করেছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার টন। গতকাল সোমবার (১০ জুলাই) পর্যন্ত মজুতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮৮০ টন। অথচ খুচরা বাজারে এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি আলুর দাম বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। এর জন্য মজুতদারদের দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। বেশি লাভের আশায় তারা আলু বিক্রি করছেন না। তবে মজুতকারী ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, আগের তিন মৌসুমে আলু মজুত করে লোকসান গুনতে হয়েছে। এবার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে চান তারা।

 জেলার কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অ্যাস্টেরিক, কার্ডিনাল ও ডায়মন্ড জাতের প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। মাসখানেক আগেও যা ছিল ৩০ টাকা। দেশি জাতের পাকড়ি (লাল গুটি) আলু ওই সময় ৪০ টাকায় পাওয়া যেত। এক মাস পরে এর দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা।

 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন ও মজুতের তথ্য পাওয়া গেছে। এলাকার অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকই উৎপাদিত আলু বিক্রি করে দেন। যে কারণে কোনো কৃষকের ঘরে এখন আলু নেই। সব কিনে হিমাগারে মজুত করেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা সীমিতভাবে আলু সরবরাহ করছেন, যা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে আলুর দাম বেড়েই চলেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার ভাড়াসহ প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) অ্যাস্টেরিক, ডায়মন্ড ও কার্ডিনাল আলু হিমাগারে সংরক্ষণে খরচ পড়ছে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা। সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭৫০ টাকায়। একই পরিমাণ দেশি পাকড়ি জাতের আলু সংরক্ষণে হিমাগারে খরচ পড়ছে দেড় হাজার টাকা, যা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। সংরক্ষণের মাত্র চার মাসের ব্যবধানে প্রতি বস্তা আলুতে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা।

অ্যাস্টেরিক, ডায়মন্ড, কার্ডিনাল ও লাল পাকরি জাতের ৬ হাজার ৬০০ বস্তা (৬০ কেজির) আলু এবার স্থানীয় কয়েকটি হিমাগারে মজুত করেছেন কালাই উপজেলার পুনট হাটের মিঠু ফকির। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১ হাজার ৮০০ বস্তা বিক্রি করেছেন। দাম আরও বাড়বে– এমন আশায় আর বিক্রি করছেন না। তাঁর ৪ হাজার ৮০০ বস্তা আলু মজুত রয়েছে।

কালাই পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজারের ব্যবসায়ী বাবু মিয়া মৌসুমের শুরুতেই তিন হাজার বস্তা আলু হিমাগারে মজুত করেন। দিন দুয়েক আগে ১ হাজার ৭৫০ টাকা দরে কার্ডিনাল জাতের ২৫০ বস্তা আলু বিক্রি করেছেন। মজুত করা ২ হাজার ৭৫০ বস্তা আলু এখন আর বিক্রি করবেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখনও বিক্রির অনেক সময় রয়েছে।

মাসখানেক আগে অ্যাস্টেরিক, ডায়মন্ড ও কার্ডিনাল জাতের প্রতি বস্তা আলু ১ হাজার ৪২০ থেকে ১ হাজার ৪৩০ টাকায় কিনেছেন কালাই পৌর কাঁচাবাজারের খুচরা ব্যবসায়ী অশোক কুমার। তিনি বলেন, প্রতি কেজির দাম পড়েছিল সাড়ে ২৩ টাকা করে। পচা ও শুকিয়ে যাওয়া আলু বাদ দিতে হয়। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ যুক্ত হলে প্রতি কেজির দাম ২৫ টাকা পড়ে। তিনি ৪-৫ টাকা লাভে ৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।

এক মাসের ব্যবধানে একই পরিমাণ আলু অশোককে কিনতে হয়েছে ১ হাজার ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। কেজিপ্রতি দাম পড়ছে ৩০ টাকায়। পরিবহন ও অন্যান্য খরচ আগের মতোই যুক্ত করতে হয়। তিনি বলেন, হিমাগারে আলু থাকলেও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বস্তাপ্রতি ২০-৩০ টাকা বেশি দিলেই আলুর খোঁজও মেলে। এর খরচ বাড়লেও লাভ আগের মতোই থাকছে। খুচরা বিক্রেতার তুলনায় মজুতদারেরা বেশি লাভবান হচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

জয়পুরহাট সদরের বানিয়াপাড়া গ্রামে আব্দুল মালেক বলেন, চাহিদা থাকলেও আলু পাওয়া যাচ্ছে না। তিন-চার দিনেও এক ট্রাক আলু ঢাকায় পাঠাতে পারছেন না। বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি দেখে হিমাগারে মজুত করা আলু ছাড়তে চাইছেন না।

কালাই উপজেলার মোলামগাড়ী হাটের আলুর মজুতদার সাইদুর রহমান দাবি করেন, আলু মজুত করে আগের তিন বছরে বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান হয়েছে। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘তখন আমাদের কেউ খোঁজও নিতে আসেননি। এবার আলুর দাম একটু বেশি হতেই সবাই চিৎকার শুরু করেছেন। অথচ বাজারে অন্যান্য সবজির দাম কত বেশি। সে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।’

জেলার হিমাগারগুলোতে কৃষকের চেয়ে ব্যবসায়ীরাই আলু মজুত বেশি করেন বলে জানান মোলামগাড়ী নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আগের তিন বছর আলুতে লোকসান হয়েছে। এবার বাজারদর ভালো হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা করতে চাইছেন। তাই এখনই আলু বিক্রি করছেন না কেউ। হিমাগার থেকে দৈনিক আলু বিক্রিতে ধীর গতি দেখছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাহেলা পারভিন বলেন, জেলায় এবার আলুর কোনো ঘাটতি নেই। প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মোট চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টন। ১৯টি হিমাগারে মজুত করা আলুর পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ৮৮০ টন।

জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রতন কুমার রায় বলেন, কয়েক মাসে প্রায় ৪০ হাজার টন বিক্রি হয়েছে। এখনও বিপুল পরিমাণ আলু মজুত রয়েছে। দাম এভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।