যে কারণে ন্যাটো সদস্যপদ ইউক্রেনের কাছে বাঁচা-মরার প্রশ্ন

যে কারণে ন্যাটো সদস্যপদ ইউক্রেনের কাছে বাঁচা-মরার প্রশ্ন

যে কারণে ন্যাটো সদস্যপদ ইউক্রেনের কাছে বাঁচা-মরার প্রশ্ন। - ছবি : সংগৃহীত

ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলের এক ঘন জঙ্গলে ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি ইউনিট রণাঙ্গনে যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের অনেকে রণাঙ্গনে ফিরে যাবে, তবে অনেকের জন্য এটাই হবে প্রথম কোনো রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে যাওয়া। যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছে বা আহত হয়েছে, ওই সব সৈনিকদের স্থান পূরণ করবে তারা।

একটি ফাঁকা জায়গায় তারা একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। তবে খুব বেশি গুলি যেন খরচ না হয়, তার জন্য তারা সতর্ক। কেবল ওই প্রশিক্ষণ শিবিরে নয়, ইউক্রেনের সামরিক রসদের সরবরাহে টান পড়েছে আরো অনেক জায়গায়।

সেনাদলের অধিনায়ক রোমান বলেন, ‘যুদ্ধ জেতার মতো যথেষ্ট মনোবল আমাদের অবশ্যই আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এখন যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র নেই। যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র পাওয়াটা এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি জানালেন, যুদ্ধের মাঠেও এখন তাদেরকে সবকিছু হিসাব করে খরচ করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এটা তো গোপন কোনো ব্যাপার নয়। শত্রুরা প্রতিদিন আমাদের বিরুদ্ধে যত গোলাবারুদ ব্যবহার করে, তা আমাদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি।’

মিত্রদের কাছ থেকে ইউক্রেন এই যুদ্ধে যেসব অস্ত্রশস্ত্র পায়, সেগুলো তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিলনিয়াসে ন্যাটো জোটের যে সম্মেলন এখন চলছে, তা রোমান ও তার মতো আরো অনেক ইউক্রেনিয়ান সৈন্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক মূহূর্ত। কারণ লড়াই চালিয়ে যেতে তাদের যা দরকার, তা নির্ভর করছে ওই সম্মেলনের ওপর।

বেশ ব্যাপক একটা প্রত্যাশা আছে, ওই সম্মেলন থেকে ইউক্রেনকে আরো অস্ত্রশস্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে। একই সাথে গোলা-বারুদ, সামরিক রসদ।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের বর্তমান মওজুদ থেকে ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত সপ্তাহে, তার একটা উদ্দেশ্য নতুন অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ না আসা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়টার চাহিদা পূরণ করা।

কিন্তু ইউক্রেনের কাছে ওই সম্মেলন কেবল অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদের ব্যাপার নয়। ইউক্রেন যে ওই সামরিক জোটে যোগ দিতে চাচ্ছে, তার ব্যাপারে সম্মেলন থেকে কী ধরনের অঙ্গীকার পাওয়া যাবে, তা তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ন্যাটোর দরজায় ইউক্রেন কড়া নাড়ছে বহু বছর ধরে। তারা কেবল কিছু ইতিবাচক কথা-বার্তায় সন্তুষ্ট নয়। তাদের মধ্যে এমন একটা বোধ তৈরি হয়েছে, যেন তাদের স্থায়ীভাবে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ইউক্রেন চায় এর চেয়ে বেশি কিছু।

ন্যাটো সামরিক চুক্তির একেবারে মূলে আছে আর্টিকেল-৫। যেটিতে বলা হয়েছে, যেকোনো সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ সব দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ বলে গণ্য হবে। সম্মিলিত প্রতিরক্ষার ওই নীতি ইউক্রেনকে সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু ন্যাটোর প্রায় সব সদস্য দেশই একমত যে একটি দেশ যখন আগে থেকেই যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে, তখন তাকে ন্যাটোর সদস্য করা কঠিন।

ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখপাত্র ওলেগ নিকোলেংকো বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অনেক আগেই আমন্ত্রণ জানানো উচিৎ ছিল। নেটোতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর মানে তো এই নয় যে সাথে সাথে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হয়ে যাবে। আমরা এটা বুঝি, যতদিন যুদ্ধ চলছে, ততদিন ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। আমরা তো বলছি, আমাদের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হোক এবং কতদিনের মধ্যে এটা ঘটবে তার একটি সুস্পষ্ট সময়সীমা ঠিক করা হোক।’

বুখারেস্টে ২০০৮ সালে নেটো জোটের যে সম্মেলন হয়েছিল, তখন ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে তাদের ন্যাটো জোটের সদস্য করার কথা বিবেচনা করা হবে। কিন্তু কিভাবে তা ঘটবে স্পষ্ট করে বলা হয়নি এবং শিগগিরই ঘটবে এমন কোনো প্রত্যাশা কখনোই করা হয়নি।

বুখারেস্ট সম্মেলনের ওই ঘটনা রাশিয়াকে ক্রুদ্ধ করেছিল। ইউক্রেন বা জর্জিয়ার সুরক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা ন্যাটো জোট করেনি। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়ায় আক্রমণ চালায়। এরপর ইউক্রেনেও প্রথমে ২০১৪ সালে, তারপর ২০২২ সালে। বুখারেস্ট সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের যারা অংশ নিয়েছিল, তারা এখন স্বীকার করেন ন্যাটোর ওই সিদ্ধান্ত ছিল ভুল।

এবার ইউক্রেন আরো সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং দৃঢ় নিশ্চয়তা চায়। ইউক্রেনকে সদস্য করার ব্যাপারে কী ধরনের অঙ্গীকার করা হবে এবং কত দিনের মধ্যে তা ঘটবে, সেগুলোর বিরাট প্রভাব পড়বে যুদ্ধের ওপর।

অনেকে যুক্তি দিচ্ছে, যদি বলা হয় যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই কেবল ইউক্রেনকে সদস্য করা হবে, তাহলে রাশিয়া এই পথ বন্ধ করার জন্য সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে নিচু মাত্রার লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু ন্যাটোর অনেক সদস্য দেশই আসলে এই মুহূর্তে ইউক্রেনকে কোনো অঙ্গীকার করার ব্যাপারে বেশ সতর্ক। তাদের আশঙ্কা, এর ফলে রাশিয়ার সাথে ন্যাটো জোটের সত্যিকার যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

তবে এমন কথা-বার্তায় ইউক্রেন বেশ ক্ষুব্ধ।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট অফিসের উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে অনেক দিন ধরেই ন্যাটো জোট সময়ক্ষেপণ করে যাচ্ছে যে রাশিয়া তাদেরকে কিছু করতে দিবে কি-না, তা নিয়ে। ন্যাটোকে একেবারে খোলাখুলি কোনো রাখ-ঢাক না করে বলতে হবে যে রাশিয়ার হুমকির সাথে এই সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টি শর্তযুক্ত নয়।’

ইউক্রেনিয়ানরা মনে করে যে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ থামানোর একটা পথ হচ্ছে তাদের ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়া। কারণ এতে যুদ্ধ আর বাড়বে না, বরং তা রাশিয়াকে ঠেকাবে। তবে তারা স্বীকার করে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি বেশ স্পষ্ট করে বলেছেন, এজন্য ইউক্রেনে অনেক সংস্কার দরকার হবে। যেকোনো দেশ ন্যাটোর সদস্য হতে হলে এসব সংস্কার জরুরি।

তবে ইউক্রেনিয়ানরা যুক্তি দেখায়, ন্যাটো তো গঠনই করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মস্কোকে মোকাবেলার জন্য। অথচ এখন ন্যাটোর হয়ে ইউক্রেনকেই কার্যত রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। ন্যাটোর পূর্ব দিকের সীমান্ত এখন রক্ষা করছে কার্যত ইউক্রেন, আর সেখানে প্রতিদিন লড়াইয়ে নিহত হচ্ছে ইউক্রেনের সৈন্য এবং বেসামরিক মানুষ।

ন্যাটো জোটের ভেতরে অনেকে মনে করে, ইউক্রেনকে সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর অনেক ঝুঁকি আছে। কিন্তু কিয়েভের অনেকের মতে, এটা ভুল। তাদের প্রশ্ন, যদি কিছু করা না হয় তাহলে কিসের ঝুঁকি?

তবে প্রকাশ্যে ইউক্রেনিয় কর্মকর্তারা বেশ আশাবাদী, তাদের কথাবার্তাই বলে যাচ্ছেন। যদি তাদের কোনো অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় বা একটি ‘শিথিল নিরাপত্তার’ নিশ্চয়তা দেয়া হয়, তখন কী হবে তা নিয়ে তারা কথাবার্তা বলতে চায় না। তারা এমন কিছু বলতে চায় না, যেন মনে হতে পারে ইউক্রেন অকৃতজ্ঞ। কারণ ন্যাটো জোটের কাছ থেকে তাদের এখনো অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদের সরবরাহ দরকার।

তবে ইউক্রেনকে যদি পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ জোটে না রাখা হয়, তখন দীর্ঘ মেয়াদে কী ঘটবে, তা নিয়ে অনেক ইউক্রেনিয় কর্মকর্তাই একান্তে তাদের দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন।

তাদের মতে, মস্কো তখন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বলার চেষ্টা করবে।

একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে বলেন, ‘দেখ, পশ্চিমারা কিভাবে ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করেছে। পশ্চিমাদের বিশ্বাস করা যায় না। তখন ইউক্রেনের মানুষেরও মনে হতে পারে, তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।’

ইউক্রেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য করা না হলে পাশ্চাত্যের দেশগুলো অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সরবরাহ কত দিন অব্যাহত রাখবে তা একটা দুশ্চিন্তা। কারণ যুদ্ধে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মধ্যেও ক্লান্তি আসতে পারে। ভ্লাদিমির পুতিন ও রাশিয়া হয়ত বা তার ওপরই ভরসা করছে।

কিয়েভে ইউক্রেনের সরকার কি এটা নিয়ে চিন্তিত?
প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমার একটা পাল্টা প্রশ্ন আছে। ইউক্রেনকে সমর্থন করতে করতে ক্লান্ত বলতে আপনি কী বুঝাচ্ছেন?’

তিনি বলেন, ‘এর মানে কিন্তু দাঁড়াবে গণতান্ত্রিক দেশগুলো জানে না কিভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হয়। এর মানে হবে, যেকোনো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র যদি তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা থাকে, তারাই সবসময় জিতবে।’