ভারতের জ্ঞানবাপী মসজিদে ‘খোঁড়াখুঁড়ি’ চালানো নিয়ে বিতর্ক

ভারতের জ্ঞানবাপী মসজিদে ‘খোঁড়াখুঁড়ি’ চালানো নিয়ে বিতর্ক

ভারতের জ্ঞানবাপী মসজিদে ‘খোঁড়াখুঁড়ি’ চালানো নিয়ে বিতর্ক

ভারতের কাশীতে জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্ত্বরে দেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আজ (সোমবার) সকালে তাদের ‘সার্ভে’ শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই নাটকীয়ভাবে সুপ্রিম কোর্ট তার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে।দেশের যে সব বিতর্কিত ধর্মীয় কাঠামোকে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা আগে মন্দির ছিল বলে দাবি করে থাকেন, কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ তার অন্যতম। এই মসজিদ ও তার লাগোয়া কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরকে ঘিরে বিতর্কও অনেক পুরনো।

জ্ঞানবাপী মসজিদ কর্তৃপক্ষের তরফে সিনিয়র আইনজীবী হুজেফা আহমদি দেশের শীর্ষ আদালতকে জানান, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তরফে ইতিমধ্যেই মসজিদের পশ্চিম প্রান্তের দেওয়ালে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেয়া হয়েছে।যদিও সরকারের তরফে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা ওই বক্তব্যকে নস্যাৎ করে পাল্টা দাবি করেন, “মসজিদ প্রাঙ্গণের একটা ইঁটও সরানো হয়নি এবং সে রকম কোনও ভাবনাও নেই।”মসজিদ কর্তৃপক্ষর তরফে অবশ্য এর পরেও প্রশ্ন তোলা হয়, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের "এত তাড়াহুড়ো করে" সার্ভে চালানোর দরকারটা কী?

দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে প্রধান বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী বুধবার (২৬ জুলাই) বিকেল ৫টা পর্যন্ত পর্যন্ত জ্ঞানবাপীতে প্রত্নতত্ব বিভাগের ‘সার্ভে’ বন্ধ রাখতে হবে এবং মসজিদ চত্ত্বরের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে।আগামী দু'দিনের মধ্যে যাতে মসজিদ কর্তৃপক্ষ এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই সার্ভের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পান, সেই সময়টা দিতেই এই স্থগিতাদেশ জারি করা হল বলেও প্রধান বিচারপতি স্পষ্ট করে দেন।

এর আগে কাশী বা বারাণসী শহরের একটি স্থানীয় আদালত গত শুক্রবার দেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে এই সার্ভে শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিল।তিন দশক আগে যেভাবে অযোধ্যা বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে পরবর্তীকালে রামমন্দির গঠনের পথ প্রশস্ত করা হয়েছিল, ভারতের মুসলিম সমাজের অনেকেই আশঙ্কা করছেন এখন কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদকে ঘিরেও এখন অনেকটা একই ধরনের পাঁয়তারা কষা হচ্ছে।

বিতর্কের শুরু যেভাবে

জ্ঞানবাপী মসজিদ নতুন করে খবরের শিরোনামে আসে ২০২১ সালের গোড়ার দিকে, যখন একদল হিন্দু মহিলা ওই মসজিদের ভেতরে হিন্দু দেবদেবীদের পূজা করার অনুমতি চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হন।বারাণসীর একটি নিম্ন আদালত তখন মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে ‘ভিডিও সার্ভে’ চালানোর নির্দেশ দেয় – আর সেই সার্ভেতে মসজিদের একটি অংশে এমন একটি কাঠামোর সন্ধান পাওয়া যায় যাকে হিন্দুদের অনেকে ‘শিবলিঙ্গ’ বলে দাবি করেন।

তবে জ্ঞানবাপী মসজিদের ম্যানেজমেন্ট কমিটি তখন থেকেই বলে আসছে, ওই কাঠামোটি আসলে তাদের ‘ওজুখানা’র ভেতরে একটি ফোয়ারা ছাড়া কিছুই নয়।ওজুখানা হল মসজিদের সেই অংশ যেখানে নামাজের আগে মুসল্লিরা তাদের হাত-পা ধুয়ে থাকেন।

বিষয়টির সংবেদনশীলতা অনুধাবন করে এর পরেই দেশের সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের ভেতরে ওয়াজুখানাটি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়।কিন্তু জ্ঞানবাপীকে নিয়ে আইনি লড়াই এর পরেও থামেনি। পূজার অনুমতি চেয়ে হিন্দু মহিলাদের করা মূল আবেদনটি নাকচ করে দিতে মসজিদ কর্তৃপক্ষের আর্জি এলাহাবাদ হাইকোর্ট গত মে মাসে খারিজ করে দেয়।

এর পরে বারাণসীর নিম্ন আদালতের রায় অনুযায়ী মসজিদে সার্ভে চালাতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আর কোনও বাধা ছিল না – তবে ওয়াজুখানাকে এই সার্ভের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল।গত শুক্রবার বিকেলে বারাণসীর নিম্ন আদালত নতুন করে সেই নির্দেশ দেওয়ার পর আজ সাতসকালেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দল মসজিদে হাজির হয়ে যায়।

তবে মসজিদ কর্তৃপক্ষ আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন, তারা এতে কোনও সহযোগিতা করবেন না। সুপ্রিম কোর্টে তাদের আইনজীবী অভিযোগ করেন, সার্ভের নামে আসলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দিয়েছে।কিন্তু সেই দাবি নাকচ করে দিয়ে সলিসিটর জেনারেল বলেন, মসজিদের ভেতরে ‘মাপজোক, ফোটোগ্রাফি আর রাডার স্টাডি’ ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আর কিছুই করছে না।

তবে এর পরেও সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, পরবর্তী আড়াই দিনের জন্য সেই সার্ভে বন্ধ রাখতে হবে – কারণ এটা বোঝাই যাচ্ছে নিম্ন আদালতের রায় কার্যকর হওয়ার আগে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ সময় পাননি।

জ্ঞানবাপীর ইতিহাস

ভারতের মুসলিম নেতারা অনেকেই মনে করছেন বারাণসীতে কোর্টের রায় অসাংবিধানিক এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ভূমিকাও আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ।

এই রায় অযোধ্যার পর ভারতে আর একটি মন্দির-মসজিদ বিবাদ নতুন করে উসকে দেবে বলেও অনেক পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন।ভারতের সুপ্রাচীন শহর বারাণসী বা কাশী, যা এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংসদীয় কেন্দ্রও বটে, সেখানে হিন্দুদের কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও মুসলিমদের জ্ঞানবাপী মসজিদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকশো বছর ধরে।

সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য মহম্মদ তৌহিদ খানের কথায়, "সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সার্ভে কমিশনকে দায়িত্ব দেয়ার নির্দেশ সমীচিন হয়নি বলেই আমরা মনে করি।"অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য জাফরইয়াব জিলানিও প্রশ্ন তুলেছেন, জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে একটি মামলা যখন এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিচারাধীন আছে এবং হাইকোর্ট সেখানে তাদের রায় মুলতুবি রেখেছেন - সেখানে কীভাবে সিভিল জজ এই আদেশ দিতে পারেন?

তা ছাড়া ভারতে ১৯৯১ সালে পাস হওয়া ধর্মীয় উপাসনালয় আইনও বলে, অযোধ্যা ছাড়া দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। বারাণসী সিভিল কোর্টের নির্দেশ সেই রায়েরও লঙ্ঘন বলে অনেকে মনে করছেন।দেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মৃদুলা মুখার্জি যেমন বিবিসিকে বলছিলেন, "ওই আইনটাতে পরিষ্কার লেখা আছে দেশের সব ধর্মস্থানে যেভাবে উপাসনা চলছে সেটাকে কেউ বদলাতে পারবে না।""শুধু অযোধ্যায় রামমন্দির-বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণকে সেই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল।"কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো আগামী বছরের নির্বাচনের আগে জ্ঞানবাপী মসজিদকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করতে চাইছে বলেই তাঁর বিশ্বাস।

‘প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নিরপেক্ষ নয়’

হায়দ্রাবাদের প্রভাবশালী এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি-ও নিম্ন আদালতের রায়ের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, “ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আগেও বহু হিন্দুত্ববাদী মিথ্যার ধাত্রী হিসেবে কাজ করেছে - তাদের কাছ থেকে কোনও নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না।”

ভারতের সুপরিচিত ইসলামী পন্ডিত আতিকুর রেহমানও বলছেন, “পঞ্চাশ বা ষাটের দশকেই কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ট্রাস্ট ও জ্ঞানবাপী মসজিদ কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল এই রায় তার লঙ্ঘন।”“তা ছাড়া নানি পাল্কিওয়ালার মতো কিংবদন্তী আইন-বিশেষজ্ঞ অযোধ্যা মামলার শুনানিতেই বলেছিলেন আদালত আইনের প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাবে - প্রত্নতত্ত্ব বা ইতিহাসের ভেতর ঢোকার এক্তিয়ার কিন্তু তাদের নেই।”“আর অযোধ্যায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নাটক তো আমরা এর মধ্যেই দেখে ফেলেছি”, বিবিসিকে আগেই বলেছিলেন আতিকুর রেহমান।

ভারতে রামমন্দির আন্দোলনের সময় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর খুব জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, "ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়!"যাতে প্রচ্ছন্ন হুঙ্কার ছিল, অযোধ্যায় মসজিদ ভেঙে রামমন্দির গড়ার পর তারা কাশী-মথুরাতেও মসজিদ দখলের অভিযানে নামবে।জ্ঞানবাপী মসজিদের ভেতরে সার্ভের নির্দেশে সেই হুমকি বাস্তবায়নেরই চেষ্টা দেখতে পাচ্ছেন অনেক পর্যবেক্ষক।

সূত্র : বিবিসি