নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় কোন্দল কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে আওয়ামী লীগের জন্য?

নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় কোন্দল কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে আওয়ামী লীগের জন্য?

নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় কোন্দল কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে আওয়ামী লীগের জন্য?

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহল। এ কারণে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যও দলের নেতাকর্মীদের কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে।রোববার দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের যে বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেই এ বিষয়টি উঠে এসেছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা আশা করছেন, স্থানীয় রাজনীতির কারণে অনেক সময় দলীয় বিভক্তি তৈরি হলেও জাতীয় নির্বাচনের সময় তা থাকবে না।তবে রাজনীতি পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের যে কয়েক মাস বাকি আছে, তার মধ্যে এসব দ্বন্দ্ব মেটানো কঠিন হবে দলটির জন্য।

বর্ধিত সভায় এসেছে যেসব প্রসঙ্গ
রোববার গণভবনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের এমন একজন নেতা জানিয়েছেন, সভায় তৃণমূলের যে নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে কয়েকজন নিজ নিজ এলাকায় দলের ভেতরের কোন্দল বা দলাদলির অভিযোগ করেছেন।তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণ, পছন্দের লোকেদের প্রাধান্য দেয়া এবং দলের ত্যাগী কর্মীদের প্রতি অবহেলার অভিযোগ করেছেন।

সভায় মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের নাম উল্লেখ না করে অভিযোগ করেন স্থানীয় নেতারা। স্থানীয় নির্বাচনে অনেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সহায়তা করেছেন, এমন অভিযোগ করেছেন বর্ধিত সভায় বক্তব্যে দেয়া কয়েকজন নেতা।কোন্দলে জড়িত এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তারা দলের সভাপতিকে অনুরোধ করেছেন।কেবল দলীয় কোন্দল নয়, আর্থিক অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে অনেক নেতার বিরুদ্ধে।

সভায় কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দলের নাম ব্যবহার করে ধনী হয়ে উঠেছে, কিন্তু দলের কর্মসূচিতে তারা যান না, দলের কর্মীদের মূল্যায়ন করেন না।ওই সভাতেই যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে দল দুই ভাগে বিভক্ত- একটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ, আরেকটা ‘আমি লীগ’।’আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা বলেন, যেসব এলাকায় বড় ধরনের বিভক্তি রয়েছে, অন্তঃকলহ রয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই তার সমাধান করতে হবে।

পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, আমার জেলায় অন্য জায়গায় তেমন দলীয় সমস্যা নেই। কিন্তু বাউফলে কেন যে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হাতাহাতি হয়, তা বুঝি না।আমি মনে করি, কেন্দ্র থেকে বাউফল নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে এর সমাধান করতে হবে।

সভায় উপস্থিত সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওই সভায় স্থানীয় পর্যায়ের ৪৩ জন নেতা বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগের বক্তব্যে স্থানীয় মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেরিয়ে এসেছে।তারা বলেন, সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দলীয় নেতাকর্মীদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়া হয় না।দলের সভাপতি শেখ হাসিনা তার সমাপনী বক্তব্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

তিনি বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে যাকে নৌকা প্রতীক দেয়া হবে, তার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নির্বাচনে জয়ী হতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’বর্ধিত সভায় অংশ নেয়া সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য হাত তুলে ওয়াদা করার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা, উপস্থিত সবাই হাত তখন তোলেন।

দলীয় কোন্দল কতটা চ্যালেঞ্জিং আওয়ামী লীগের জন্য?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আওয়ামী লীগের নেতা বলেছেন, দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের ভেতরে নানা রকম গ্রুপিং বা কোন্দলের তৈরি হয়েছে।

উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন নেতার লোক হিসেবে দলের মধ্যেই নানা ভাগ তৈরি হয়েছে।

গত কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনের সময় এই বিরোধের বিষয়টি প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে।বিশেষ করে সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় দলীয় কোন্দলের কারণে অনেক স্থানে সহিংসতা এবং হতাহত হয়েছে।

এ ধরনের কোন্দলে জড়িত থাকার অভিযোগে সে সময় কয়েকজন সংসদ সদস্য বা কেন্দ্রীয় নেতাকে দল থেকে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য তাদের আবার দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।দলীয় কোন্দলের সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা গেছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। বিদ্রোহের জের ধরে আওয়ামী লীগের টিকেটে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

নির্বাচনে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে গেলেও সেখানে প্রার্থী করা হয় জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনকে। নিজের অনুসারীদের সমর্থনে জায়েদা খাতুন গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।এখন দলের তৃণমূল নেতারা আশঙ্কা করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দলের কোন্দল আরো তীব্র হয়ে উঠতে পারে।

তবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন, স্থানীয় নির্বাচনে কম-বেশি বিভক্তি থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের সময় তা আর থাকবে না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় একটি দলে মতভেদ বা কিছু কলহ থাকতে পারে। তিনি মনে করেন, দু’টি কারণে অভ্যন্তরীণ কলহ বেশি হয়েছে।তিনি বলেন, ‘যখন কাউন্সিল হয়েছে, সেখানে অনেকেই বিভিন্ন পদের প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু সবাই তো আর পদ পাননি। ফলে তাদের মধ্যে একটা বিভক্তি তৈরি হয়েছে। আবার স্থানীয় নির্বাচনের সময় অনেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ বিজয়ী হয়েছেন। তাদেরও নিজস্ব একটা বলয় তৈরি হয়েছে।’

কিন্তু যখন জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্ন আসবে,তখন দলকে বিজয়ী করতে সবাই একযোগে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন।তিনি বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচন বা রাজনীতিতে এসব থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের সময় আর নিজেদের মধ্যে এসব কোন্দল থাকবে না। তখন সবাই নৌকাকে বিজয়ী করার জন্য একসাথে, একযোগে কাজ করবেন। আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই নিদের্শই দিয়েছেন, যা সব নেতা-কর্মী মানবেন।’

বিশ্লেষকেরা কী বলছেন?
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরেই যেরকম নানা দল-উপদলের তৈরি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যকার বিভক্তি খুব সহজে সমাধান হবে না।

বিশেষ করে যেখানে আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের ভেতরের দূরত্ব বা মতবিরোধ দূর করে একত্রে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে, যার প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় নির্বাচনে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো আওয়ামী লীগের জন্য ‘সর্বোচ্চ মাত্রার একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার’ হবে।

তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, এটা পুরোপুরি সুরাহা হবে না। কারণ এখন একটা ধারণা জন্মে গেছে, আমি নমিনেশন পাওয়া মাত্র শিওর শট। এ রকম চিন্তা যখন বিকশিত হতে থাকে, প্রত্যেকে মরিয়া হয় ‘রাজনীতির এই বিশ্লেষক মনে করেন, সর্বোচ্চ পর্যায়কে অগ্রাহ্য করার সাহস হয়ত কারো হবে না, অর্থাৎ যিনি নমিনেশন পাবেন, তার বিরুদ্ধে হয়তো কেউ প্রকাশ্যে লড়াই ঘোষণা করবে না।কিন্তু উৎসাহের সাথে লোকজনকে মাঠে নামানো খুব কঠিন হবে।

জাতীয় নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি রয়েছে। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে তখন বিজয়ী হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে অভ্যন্তরীণ বিরোধ মিটিয়ে একযোগে তাদের কাজ করতে হবে।না হলে কোথাও কোথাও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো ‘প্রভাব পড়তে পারে’ বলে তাদের আশঙ্কা।কিন্তু এই স্বল্প সময়ে দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব বা বিভক্তি কতটা মেটানো যাবে, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশ্লেষকদের।

বিশেষ করে অনেক এলাকায় দলের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া তা মেটানো মুশকিল।অধ্যাপক মজুমদার বলছেন, ‘হয়তো বিদ্রোহ কমে যাবে, কিন্তু নির্বাচনের সময় নমিনেশন না পেলে তারা কী করবেন, তা বলা মুশকিল। আসলে বড় যেকোনো দলের জন্যই এমন চ্যালেঞ্জ আছে, তবে ক্ষমতাসীন হওয়ায় আওয়ামী লীগের মধ্যে হয়তো একটু বেশি দেখা যাচ্ছে।’

সূত্র : বিবিসি