করোনা স্বাস্থ্যসেবায় চিকিৎসকদের একক নিয়ন্ত্রণ ডেকে আনবে ভয়াবহ বিপর্যয়

করোনা স্বাস্থ্যসেবায় চিকিৎসকদের একক নিয়ন্ত্রণ  ডেকে আনবে ভয়াবহ বিপর্যয়

ইমদাদুল হক সোহাগ

কোভিড-১৯ যা করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত – সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। মিডিয়াকর্মী থেকে শুরু করেগবেষক, চিকিৎসক, আমলা সকল পেশার মানুষেরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে করোনা সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তাত্বিক বিশ্লেষণ করে চলেছেন। আমার আজকের লেখার বিষয়টি একটু ভিন্ন ধরনের।করোনা মহামারি বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার যে অব্যবস্থাপনা আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সেই অব্যবস্থার একটা বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।বিজ্ঞান শব্দটা শুনলেই আমাদের অনেকের কাছেই মনে হতে পারে হয়তো জটিল কিছু,তাই জটিল বিষয়টিকে সরলভাবে উপস্থাপনের নিমিত্তে প্রথমেই একটি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। কোন এক রাজ দরবারে একদিন এক জেলে একটি বড়সড় মাছ নিয়ে গেলো । রাজামশাই মাছটি দেখে খুব খুশি হলেন কারণ মাছ তাঁর খুব প্রিয় খাবার ছিলো । এজন্য রাজামশাই খুশি হয়ে জেলেকে ৫০০/-টাকা দিয়ে দিলেন ।এদিকে পাশেই বসে থাকা রাণী ফিসফিস করে রাজাকে বললেন, এই সামান্য টাকার মাছটার দাম তুমি ৫০০/-টাকা দিয়ে দিলে?বড়জোর খুশি হয়ে তাকে ৮০/- থেকে ১০০/- টাকা দিতে পারতে । মাছ ফেরত নিয়ে টাকা দিতে বলো! রাজামশাই বললেন, একি বলো রাণী ! রাজারা যা বলে তা নড়চড় করা অসম্ভব তাছাড়া এটাতো রাজাদের ইজ্জতের ব্যাপার ।রাণী বললেন, আমি এমন একটা বুদ্ধি দিচ্ছি যা প্রয়োগ করলে তোমার সন্মানের কোনো হানি হবে না । জেলে মাছ নিয়ে টাকাও ফেরত দিবে। রাজামশাই বললেন কি বুদ্ধি ?রাণী বললেনঃজেলেকে ডেকে বলবে, তোমার মাছটা কি পুরুষ না স্ত্রী ? যদি জেলে বলে মাছ পুরুষ তাহলে তুমি বলবে আমার স্ত্রী মাছ লাগবে আর যদি জেলে বলে মাছ স্ত্রী তাহলে তুমি বলবে আমার পুরুষ মাছ লাগবে!অতএব, জেলে তখন মাছ ফেরত নিতে বাধ্য হবে!রাজা রাণীর বুদ্ধিতে খুশি হয়ে জেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মাছটা কোন জাতের ? পুরুষ না স্ত্রী ? জেলে থতমত হয়ে একটু ভেবে চিন্তে বললো, যাঁহাপনা আমার মাছটা পুরুষও না স্ত্রীও না ! আমার মাছটা হলো হিজড়া! এবার রাজদরবারে হাসির রোল পড়ে গেলো, রাণীও শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে হাসলেন!রাজা জেলের বিচক্ষণতা দেখে খুশি হয়ে আরও ৫০০/- টাকা দিয়ে দিলেন । জেলে খুশি হয়ে মোট ১০০০/- টাকার পোটলায় নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে । রাজমহলের মেইন গেইটের সামনে যেতেই পোটলা থেকে পাঁচটি টাকা মাটিতে পড়ে গেলো । জেলে তা তুলে চুমু খাচ্ছে কপালে লাগাচ্ছে এদিকে রাণী তা দেখে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। যাঁহাপনা, এই জেলে এত লোভী কেন ? ১০০০/- টাকা থেকে মাত্র পাঁচটি টাকা পড়ে গেছে জেলের তা সহ্য হচ্ছেনা । যাঁহাপনা ! আপনি তাঁকে শাস্তি দেন । রাজাও ভাবলেন, ঠিকই তো মাত্র ৫/- টাকা পড়ে গেছে, গেট দিয়ে কতো গরিব মানুষ আসা যাওয়া করে তারা না হয় কুঁড়িয়ে নিতো । রাজামশাই জেলেকে ডেকে বললেনঃএই লোভী জেলে ? তোমার এতো লোভ কেন ? এতো টাকা দিয়েছি তোমায়, মাত্র ৫/-টাকার লোভ সামলাতে পারলে না ? তা তুলে চুমু খাচ্ছো ? তোমাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে ।জেলে বললঃ যাঁহাপনা ! আমি কিন্তু লোভের কারণে ঐ টাকাটা তুলে চুমু খাইনি।টাকার গায়ে আমার রাজামশাই ও রাণী মা’র নাম লেখা আছে, তাই ভাবলাম,টাকাটা মাটিতে পড়ে থাকলে হয়তো অন্য কোনো মানুষ পা দিয়ে পিষবে আর আমার রাজা ও রাণী মা’র ইজ্জতের হানি হবে । তাই আমি টাকাটা তুলে চুমু খেলাম এবং কপালে ঠেকিয়ে সালাম করলাম ।এবার রাজামশাই আরও খুশি হয়ে জেলেকে আরও ৫০০/- টাকা দিলেন । সর্বমোট ১৫০০ /- টাকা দিয়ে জেলে বিদায় করলেন । আর রাজ ঘোষককে বললেন, তুমি সমগ্র রাজ্যে ঘোষণা করে দাও কেউ যেন বউয়ের বুদ্ধিতে না চলে । আর এটাও বলে দাও বউয়ের বুদ্ধিতে চললে 500/- টাকার জায়গায় ১৫০০/- টাকা লোকসান হয়…!

প্রিয় পাঠক অনেকেই হয়তো কৌতুহল নিয়ে ভাবছেন উপরের গল্পের সাথে করোনা বা চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষনের সম্পর্ক কি?আর অপেক্ষা নয় আসুন গল্পের আলোকে বিষয়টিকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করি।

প্রথমেই বলে রাখি বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোটাই চিকিৎসক সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসক সমাজের বাইরেও যে অন্যদের (মাল্টিডিসিপ্লিনারি) অবদান রাখার সুযোগ আছে এই বিষয়টি এদেশের চিকিৎসকরা মানতেই চান না এবং এব্যাপারে সরকারকে মিসগাইড করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বাধ্য করার কারনে রাজার বউয়ের মতো করে বউয়ের বুদ্ধিতে মানে শুধু চিকিৎসকদের বুদ্ধিতে স্বাস্থ্যসেবা খাত পরিচালিত হবার কারনেই সরকার ৫০০ টাকার জায়গায় ১৫০০ টাকা খরচ করলেও জনগণ তার কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।করোনা মহামারীতে বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ অবশ্যই সম্মুখ সমরের যোদ্ধার ভুমিকা পালন করছেন তাদের অবদান কে শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করেই চিকিৎসা ব্যবস্থায় সরকারের সমন্বয়হীনতার বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই।বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের অব্যবস্থাপনার কারনেই প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার মেডিকেল ট্যুরিজমের কারনে ইন্ডিয়া সহ বিদেশ চলে যায়।এটা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থাহীনতার কারনেই হয়েছে।আর এই আস্থাহীনতা একদিনে তৈরি হয় নি।বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারনে আমরা যারা মলিকুলার বায়োলজির জ্ঞান রাখি তারা খুব ভালো করেই জানি সঠিকভাবে রোগ নির্নয় করতে না পারলে রোগ নির্মুল করা অসম্ভব।অথচ এই রোগ নির্নয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এদেশে সম্পন্ন হয় যাদের মলিকুলার বায়োলজি তথা ডায়াগনোসিস সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞানই নেই তাদের দিয়ে।একারণেই বাংলাদেশে প্রায়শই আমরা দেখতে পাই একজন রোগীর ডায়াগনোসিস এ ক্যান্সার ধরে পরার পরে ভিটে মাটি সহায় সম্বল সবকিছু বিক্রি করে ইন্ডিয়া বা সিংগাপুরে যাওয়ার পরে জানল ক্যান্সার হয়নি! এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ পরীক্ষা করে করে বলা হলো হেপাটাইটিস-বি পজেটিভ অন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ গিয়ে দেখা গেল নেগেটিভ! সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর পিসিআর ল্যাব থেকে ভুল-ভাল রিপোর্টের কারণে পিসিআর টেস্টের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে।

আমাদের দেশের ডায়াগনোস্টিক সেক্টর যতোটা না রোগ নির্নয়ের কাজে মনোযোগী তার থেকে বেশি মনোযোগী ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য এবং এগুলোর অধিকাংশই চিকিৎসকরা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু মেডিকেল টেকনোলজিস্টের মাধ্যমে অথবা কমিশন বানিজ্যের মাধ্যমে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে। অথচ উন্নত দেশে এই কাজগুলোতে বিষয়ভিত্তিক(মাইক্রোবায়োলজিস্ট,বায়োকেমিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট)দক্ষ জনশক্তিকে ব্যবহার করা হয় যাদের মেশিন কেলিব্রেশন, ভ্যালিডেশন, মেথড অপটিমাইজেশন, স্যাম্পিলং সহ অনেক কিছুতে মলিকুলার লেভেলে জ্ঞান থাকে।ফলে সঠিকভাবে রোগ নির্নয়ের মাধ্যমে চিকিৎসকদের রোগ নির্মুলের কাজটি অনেকাংশে সহজ হয়ে যায় এবং ভুল পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে রোগিদের ভোগান্তি শতভাগ লাঘব হয়,যে কারনে তাদের চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি রোগিদের আস্তা ও অন্ধ বিশ্বাস তৈরি হয়।উন্নত বিশ্বে এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সাধারন জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস তৈরিতে, চিকিৎসক কেন্দ্রিক মনোপলি ধারনা থেকে বেরিয়ে এই খাতকে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারী ফিল্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠা সবথেকে বড় নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।আর এই মাল্টিডিসিপ্লিনারি ফিল্ডকে চিকিৎসকরা নিজেদের একক নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে চিকিৎসা সেবায় জনগণের আস্থাহীনতার মাধ্যমে দেশ শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যপারটি তা নয়,পাশাপাশি এই সেক্টরের সাথে অন্য যেসব বিষয়ভিত্তিক গ্রাজুয়েটদের (মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট) অবদান রাখার সুযোগ ছিলো তাদের কর্মক্ষেত্র কে সংকুচিত করে দেশের এই অদম্য মেধাবী সন্তানদের বঞ্চিত করার মাধ্যমে মেধা পাচারকে উৎসাহিত করছে।করোনা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের দুর্বলতাগুলো। দেশের করোনা টেস্টের বায়োসেফটি লেবেল-2 ল্যাবরেটরিসমূহ সেট আপ থেকে শুরু করে এই ল্যাব সুবিধা সারা দেশব্যাপী সম্প্রসারণে অনভিজ্ঞ চিকিৎসক (যারা কোনোদিন PCR মেশিন দেখেনাই বা PCR কোনোদিন করে নাই) সমাজ কিভাবে হিমশিম খেয়েছে সেটা আমাদের সকলেরি জানা।অথচ যারা একাজের সাথে সকাল বিকাল উঠাবসা করে যারা সরাসরি PCR কাজ করেছেন তাদের (মলিকুলার বায়োলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট ও বায়োকেমিস্ট ইন human/animal/plant research, ভ্যাক্সিন স্পেশালিষ্ট, পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি) তত্বাবধানে দিয়ে স্বাস্থ্য বিধি মেনে এই কাজ করার সুযোগ দিলে ভাল হত, না হলে PCR result False positive আর False negative এ ভরপুর হয়ে যেতে পারে।

যেটা আমাদের করোনা ব্যবস্থাপনায় ভয়ংকর পরিনতি ডেকে আনতে পারে।তাই এখনি সময় করোনার অব্যবস্থাপনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের পলিসি মেকারদের উচিত হবে সবকিছু ঢেলে সাজানো,চিকিৎসকদের মনোপলি চিন্তাভাবনার হাত থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মুক্তকরে এটাকে মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেক্টর এ পরিনত করে সকলকে সম্পৃক্ত করে মেডিকেল টুরিজমের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হওয়া সহ মেধা পাচারকে রোধ করে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সাধারণ জনগণের আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঘোষিত ভিশন ২০২১ সফল করা।

লেখকঃ ইমদাদুল হক সোহাগ
সাবেক শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া