ভারতে সব আইনসভায় এক-তৃতীয়াংশ নারী আসন রাখতে সংবিধান সংশোধন

ভারতে সব আইনসভায় এক-তৃতীয়াংশ নারী আসন রাখতে সংবিধান সংশোধন

সংগৃহীত

আইনসভাগুলিতে ৩৩ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করতে সংববিধান সংশোধন করছে ভারত। বুধবার এই সংক্রান্ত বিলটি নিম্ন-কক্ষ লোকসভায় মাত্র দু‘জনের বিরোধিতায় বৃহস্পতিবার অনেক রাতে উচ্চ-কক্ষ রাজ্যসভায় পাশ হয়েছে কোনো বিরোধিতা ছাড়াই। তবে কবে থেকে এই আইন চালু হবে, তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা আছে।

সংবিধান সংশোধনীতে বলা হয়েছে, লোকসভা, রাজ্যগুলির বিধানসভা এবং দিল্লির বিধানসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮১টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

পুদুচেরির মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির বিধানসভায় অবশ্য নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকছে না।

জাতি-ভিত্তিক সংরক্ষণ এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সংরক্ষণ
লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে তফসিলি জাতি (এসসি) এবং তফসিলি উপজাতি (এসটি) এর জন্য আসন সংরক্ষিত রয়েছে। এই সংরক্ষিত আসনগুলিরও এক-তৃতীয়াংশ এখন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

বর্তমানে ১৩১টি লোকসভা আসন এসসি/এসটি-র জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। নারী সংরক্ষণ বিল আইনে পরিণত হওয়ার পরে, এই আসনগুলির মধ্যে ৪৩ টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে। এই ৪৩ টি আসন আইনসভায় নারীদের জন্য সংরক্ষিত মোট আসনের অংশ হিসাবেই গণনা করা হবে।

এর অর্থ হল, নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১৮১টি আসনের মধ্যে ১৩৮টি এমন হবে যেগুলিতে যেকোনো জাতির নারীকে প্রার্থী করা যাবে, অর্থাৎ এসব আসনে প্রার্থী পুরুষ হতে পারবেন না।

লোকসভার বর্তমান আসন সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এই গণনা করা হয়েছে। সীমানা পুনর্বিন্যাসের পরে এই সংখ্যায় পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কবে থেকে কার্যকর হবে এই আইন?

পরবর্তী আদমশুমারি আর তার পর হবে নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা পুনর্বিন্যাসের কাজ। তারপরেই নারী সংরক্ষণ আইন কার্যকর করা হবে। লোকসভা এবং বিধানসভা কেন্দ্রের জনসংখ্যার তথ্যের ভিত্তিতে সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়।

সর্বশেষ দেশব্যাপী সীমানা পুনর্বিন্যাস হয়েছিল ২০০২ সালে, আর তা বাস্তবায়িত হয় ২০০৮ সালে। সীমানা পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে এবং লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পরে নারীদের সংরক্ষণ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নারীদের সংরক্ষণ কার্যকর করা সম্ভব নয়।

একবার কার্যকর হয়ে গেলে, নারীদের সংরক্ষণ কেবলমাত্র ১৫ বছরের জন্য বৈধ থাকবে। তবে সংসদ এই সময়সীমা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।

উল্লেখ্য, এসসি-এসটি-র জন্য সংরক্ষিত আসনগুলিও সীমিত সময়ের জন্যই ছিল, তবে সেই ব্যবস্থা একেকবারে ১০ বছর করে বাড়ানো হয়েই চলেছে।

সংরক্ষিত আসনের সিদ্ধান্ত কিভাবে ?
সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিটি প্রক্রিয়ার পর সংরক্ষিত আসনের রোটেশন হবে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত পরে নেবে সংসদ।

এই সাংবিধানিক সংশোধনী সরকারকে সংসদ এবং রাজ্য আইনসভায় নারীদের সংরক্ষণের ক্ষমতা দেবে।

আসনের রোটেশন ও সীমানা নির্ধারণের জন্য আলাদা আইন ও প্রজ্ঞাপনের প্রয়োজন হবে।

পঞ্চায়েত ও পৌরসভার মতো স্থানীয় সংস্থাগুলির এক তৃতীয়াংশ আসনও মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। প্রতিটি নির্বাচনে, আসন সংরক্ষণ পরিবর্তিত হয়, অর্থাৎ ঘূর্ণন।

একটি নির্বাচনী এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে তফসিলি জাতির জন্য আসন সংরক্ষিত।
ছোট রাজ্যগুলির জন্য পৃথক নিয়ম

লাদাখ, পুদুচেরি এবং চণ্ডীগড়ের মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে কীভাবে আসন সংরক্ষিত হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। মণিপুর ও ত্রিপুরার মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যে দুটি করে আসন রয়েছে এবং নাগাল্যান্ডে মাত্র একটি লোকসভা আসন রয়েছে।

আগের নারী সংরক্ষণ বিলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। রাজ্যসভায় সেই বিলটি ২০১০ সালে পাশ হওয়া ওই বিলে বলা হয়েছিল, যে সব রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মাত্র একটি আসন রয়েছে, সেখানে সেই আসনটি একটি লোকসভা নির্বাচনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, পরের দুটি নির্বাচনে নারী-সংরক্ষণ প্রযোজ্য হবে না।

দুই আসনের রাজ্যে দুটি লোকসভা নির্বাচনে একটি আসন সংরক্ষিত থাকবে এবং তৃতীয় নির্বাচনের সময়ে নারীদের জন্য কোনো আসন সংরক্ষিত থাকবে না।

একাধিকবার পেশ হয়েছে নারী সংরক্ষণ বিল
ঠিক ৩০ বছর আগে, সংসদ সংবিধান সংশোধন করে গ্রাম পরিষদ এবং পৌর কর্পোরেশনগুলিতে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৬ সালে সংসদ ও রাজ্য বিধানসভায় আসন সংরক্ষণের জন্য একটি বিল প্রথম প্রস্তাব করেছিল। ওই একই বিল ১৯৯৮, ১৯৯৯ এবং আবার ২০০৮ সালে সংসদে পেশ করা হয়েছিল।

প্রতিবারই বিজেপি সংসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার কারণে ইস্যুটি ভেস্তে যায়।

বর্তমানে নারীদের প্রতিনিধিত্ব কত?
সপ্তদশ লোকসভায় ৮২ জন নারী নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় ১৫ শতাংশ। একইসাথে দেশের ১৯টি রাজ্যের বিধানসভায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব ১০ শতাংশেরও কম।

জাতিসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বের পার্লামেন্টে নারীদের গড় প্রতিনিধিত্ব ২৬.৫ শতাংশ।

ভারতীয় রাজনীতির অতীত ও বর্তমানে শক্তিশালী নারীদের ইতিহাস রয়েছে। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৬৬ সালে। কয়েকটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেও রয়েছেন নারীরা।

নারী মুখ্যমন্ত্রীরা পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কয়েকটি বৃহত্তম রাজ্য পরিচালনা করেছেন এবং বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পর্যায়ে শক্তিশালী মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। দেশটির বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুসহ দু'জন নারী রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন।

গত বছর পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা যায়, বেশিরভাগ ভারতীয়ই বলেছেন, নারী ও পুরুষ সমানভাবে ভালো রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন। তথ্যে দেখা গেছে যে গত সাধারণ নির্বাচনে পুরুষ এবং নারীরা প্রায় সমান সংখ্যাতেই ভোট দিয়েছিলেন।

সূত্র : বিবিসি