করম উৎসবে মেতে উঠেছেন চা শ্রমিকরা

করম উৎসবে মেতে উঠেছেন চা শ্রমিকরা

সংগৃহীত

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে করম। ভাদ্রের শেষ, আশ্বিনের শুরুতে এই উৎসবে তরুণ-তরুণীরা গানের সুরে গাছ দেবতার প্রার্থনায় মেতে ওঠেন। সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, বড়াইক, কুর্মি, সিং, পাহান, মাহালিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ রীতিতে করম উৎসব পালন করে থাকে। করম নামের গাছের ডাল কেটে বিভিন্ন প্রাচীন প্রথা মান্য করে এই উৎসব করা হয় বলে এর নাম করম উৎসব।

এমনি এক উৎসব অনুষ্ঠিত হলো শ্রীমঙ্গলের কাকিয়াছড়া চা বাগানে। জেলার বিভিন্ন চা বাগান থেকে আগত বাড়াইক, মুণ্ডা, কুর্মি, খাড়িয়া, ভূঁইয়া, মুসহর, উরাং, তাঁতী, ভূমিজ, সাঁওতাল, খেডোয়ার, তুরি, কন্দ, তেলী, লোহার, বাগদী, শবরসহ চা বাগানের সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ উপস্থিত ছিলেন করম উৎসবে।

উৎসবে নিজ ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি বিশেষ বৃক্ষের বন্দনায় এই উৎসবে সাদা লালের মিশ্রনে শাড়ি আর খোপায় ফুল, রঙিন সাজে পূজার্চনা শেষে নাচ-গান উৎসর্গ করেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি। এতে রাত অবধি ছিল ধর্মীয় নানান আনুষ্ঠানিকতা।

রবিবার বিকেল হতে রাত অবধি পর্যন্ত কমলগঞ্জ মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির আয়োজনে এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্টপোষকতায় করম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে শ্রীমঙ্গল কাকিয়া ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ও মনিপুরি ললিতকলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের সভাপতি ড. উর্মি বিনতে সালামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সংসদীয় আসনের এমপি উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমান, পিপিএম (বার), সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কাজী নুরুল ইসলাম, শ্রীমঙ্গল উপজেলার নির্বাহী অফিসার আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুনসহ অনেকে।

যেভাবে এলো করম উৎসব

ধর্মচর্চা অনুযায়ী পুরাকালে একবার অগ্নিপ্রলয় হয়েছিল। লাভার মতো আগুন বের হচ্ছিল চারদিক থেকে। সে সময় নায়েক ও সারেন নামের ভাইবোন ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে তাদের করম গাছের নিচে আশ্রয় দেন ভগবান। আগুনে সব পুড়ে ছাই হলেও করম গাছের কোনো ক্ষতি হয়নি। রক্ষা পান নায়েক ও সারেন।

করম গাছকে ঘিরে এ পূজা করা হয় মূলত প্রকৃতি বন্দনায় ফসল যেন ভালো হয়। নিজেদের সমৃদ্ধি কামনাতেই এই পূজাতে উৎসব। নিজ ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি বিশেষ বৃক্ষের বন্দনায় পূজার্চনা শেষে নাচ-গান উৎসর্গ করেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি। প্রতিবছর ভাদ্রের শেষ আশ্বিনের শুরুতে এই উৎসবে তরুণ-তরুণীরা সবাই গানের সুরে গাছ দেবতার প্রার্থনায় মেতে উঠেন।

বৃক্ষের বন্দনায় পূজার্চনা শেষে নাচ-গান উৎসর্গ করেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি। প্রতিবছর ভাদ্রের শেষ আশ্বিনের শুরুতে এই উৎসবে তরুণ-তরুণীরা গানের সুরে গাছ দেবতার প্রার্থনায় মেতে ওঠেন। অনুষ্ঠানে ৬টি দলের কিশোর কিশোরীরা পায়ে আলতা, খোঁপায় বাহারি ফুল, শাড়ি আর ঢোল মাদলের তালে তালে রিমঝিম নাচ পরিবেশ করে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গানে মুখরিত হয়ে উঠে চারপাশ।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মণিপুরি ললিতকলা একাডেমির উপপরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, করম নামক গাছের ডাল কেটে প্রাচীন প্রথা মান্য করে এই উৎসব করা হয় বলে এর নাম করম উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একদিন আগ থেকে চা বাগানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠান শুরু করেন। নারীরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পূজার প্রথম দিন উপবাস থাকেন। মূলত উপবাস অবস্থায় করম গাছের ডাল তারা তুলে এনে একটি মাটির বেদী নির্মাণের দ্বারা ওই বেদিতে পুঁতে পূজা করে থাকেন। এটাকে কোথাও কোথাও বৃক্ষ পূজা বলা হয়ে থাকে। এটাকে বাঁচিয়ে রাখতে একাডেমি এ আয়োজন করে।

কমলগঞ্জ মনিপুরী ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র সিংহ বলেন, চা বাগানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিকট এটি একটি অন্যতম ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব। যেখানে তারা নৃত্যগীতের মাধ্যমে সারা দিনব্যাপী আনন্দ প্রকাশ করে থাকে। আমরা চা বাগানের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এই রকম একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব আয়োজন করতে পেরে সত্যি খুবই আনন্দিত।