বাংলাদেশে প্রাণঘাতী যত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে

বাংলাদেশে প্রাণঘাতী যত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে

বাংলাদেশে প্রাণঘাতী যত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রীবাহী ও মালবাহী দুটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাকে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণহানিকর দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।সড়ক, নৌ ও রেলপথে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে আর কোন রেল দুর্ঘটনায় এতো মানুষ মারা যায়নি।সোমবার বিকেলে হওয়া দুর্ঘটনাটিতে সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে আরো ৭৫ জনের বেশি।

কিশোরগঞ্জ থেকে আসা এগারোসিন্ধুর গোধূলি নামের একটি ট্রেন দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ইঞ্জিন বদল করার পর যখন জগন্নাথপুর রেল ক্রসিং পার হচ্ছিল, তখন ঢাকা থেকে আসা একটি মালবাহী ট্রেন ধাক্কা দিলে যাত্রীবাহী তিনটি বগি উল্টে যায়।

তবে এই দুর্ঘটনাটি ছাড়াও বাংলাদেশে আরো অনেক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে যাতে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯৬ জন নিহত হয়েছে। আর ২০২২ সালে ৬০৬টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছে। তবে এই সংখ্যার মধ্যে রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনাও রয়েছে।বাংলাদেশে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনা তুলে ধরা হলো যেগুলোতে কমপক্ষে ১০ জন মানুষ মারা গেছে।

সেতুর স্প্যান ভেঙ্গে বহু প্রাণহানি

তেরাশি সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়া জেলার ঈশ্বরদীতে একটি ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা হয়। ঈশ্বরদীর কাছে একটি সেতু পার হওয়ার সময় সেতুর কয়েকটি স্প্যান ভেঙ্গে পড়লে ট্রেনের কয়েকটি বগিও লাইন থেকে খসে নিচে পড়ে যায়।সেতুর নিচে শুকনো জায়গায় পড়ে যাওয়ার কারণে ওই দুর্ঘটনায় প্রায় ৬০ জনের প্রাণহানি হয় বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়।

ট্রেনে আগুন

খুলনা থেকে পার্বতীপুরের দিকে যাওয়া একটি ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে ট্রেনে আগুন ধরে যায়। এই আগুন লাগার ঘটনায় ২৭ জন মারা যায়।

সর্বহারা পার্টির ট্রেনে হামলা চালানোর অভিযোগ

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে গেলে অন্তত ২৫ জন নিহত হয়। আহত হয় আরো ৪৫ জন।সর্বহারা পার্টির সদস্যরা ট্রেনটিতে হামলা চালানোর পর এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সবচেয়ে বড় প্রাণহানির দুর্ঘটনা

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাণঘাতী ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ সালে। সেই বছরের ১৫ই জানুয়ারি টঙ্গীর মাজুখান এলাকায় দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় এবং তাতে অন্তত ১৭০ জন মারা যায়। আহত হয় আরো কয়েকশ মানুষ।

স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, টঙ্গীর কাছে উত্তর দিকে যাওয়া একটি মেইল ট্রেনের সাথে চট্টগ্রামগামী একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। নতুন সংকেত ব্যবস্থা পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনবল না থাকার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানানো হয়।

এই দুর্ঘটনার কারণে বেশ কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ধানক্ষেতে গিয়ে পড়ে। ওই সময় বিশ্ব ইজতেমা চলতে থাকার কারণে ট্রেনে ভিড় থাকায় প্রাণহানি বেশি হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়। দুর্ঘটনার সময় ট্রেন দুটিতে দুই হাজারের বেশি মানুষ ছিল বলে জানা যায়।একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম জেলার কাছে একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরো দুই শতাধিক মানুষ।

হিলি রেলস্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ

হিলি রেলস্টেশনে ১৯৯৫ সালের ১৩ই জানুয়ারি দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়।গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী একটি লোকাল ট্রেন হিলি স্টেশনের এক নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়। পরে সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন একই লাইনে ঢুকে পড়লে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে লোকাল ট্রেনের দুটি বগি সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনের উপর উঠে যায়।এতে দুই শতাধিক মানুষ আহত হয় এবং ৫০ জনের বেশি নিহত হয়।

চাঁদপুরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চাঁদপুর জেলায় ১৯৯৬ সালের ৯ই জানুয়ারি দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়।এ ঘটনায় আহত হয় আরো বহু মানুষ।সেই সময় বার্তা সংস্থা এএফপিকে বাংলাদেশের একজন রেল কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।

কুমিল্লার লাকসামে ১৯৯৮ সালের মে মাসে মালবাহী একটি ট্রেনের সাথে যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৭ জন নিহত হয়।এই দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২৬ জন আহত হয়।রেল যোগাযোগ চালু করতে এক অভিযানের মাধ্যমে মালবাহী ট্রেনটির বগি সরিয়ে নেয়া হয়।

গোধূলী ও চট্টলার সংঘর্ষ

চট্টগ্রাম ও ঢাকাগামী দুই ট্রেনের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়েছিল ২০১০ সালে।সেই বছর চট্টগ্রামগামী মহানগর গোধূলি নামে একটি ট্রেন ও ঢাকামুখী চট্টলা নামে একটি মেইল ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।এতে চট্টলা ট্রেনেরে একটি বগি মহানগর গোধূলির ইঞ্জিনের উপরে উঠে গেলে চালকসহ মোট ১২ জন নিহত হয়।

উদয়ন আর তূর্ণা নিশীথার সংঘর্ষ

চার বছর আগে ২০১৯ সালের ১২ই নভেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়।সেদিন ভোররাত তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মন্দবাগ রেলষ্টেশনে ট্রেন দু'টির মধ্যে সংঘর্ষ হয়।উদয়ন এক্সপ্রেস নামের একটি ট্রেন সিলেট থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল। আর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিল তূর্ণা নিশীথা আন্ত:নগর ট্রেন।

সেই সময় রেলওয়ে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী ট্রেনটি যখন প্রধান লাইন থেকে শাখা লাইন বা লুপ লাইনে প্রবেশ করছিল, তখন এর পিছনে আঘাত করেছে চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি।ফলে উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের শেষের কয়েকটি বগি দুমড়ে মুচড়ে যায়। যার কারণে হতাহতের এই ঘটনা ঘটে।২০১৯ সালের জুন মাসেই আরেকটি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়।

সেখানে সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে যাওয়া উপবন এক্সপ্রেসের বেশ কয়েকটি বগি কালভার্ট ভেঙ্গে লাইনচ্যুত হয়ে পাশের বড় ছড়া খালে ছিটকে পড়ে। এ ঘটনায় বেশ কয়েক জন নিহত হয়েছিল।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মোঃ হাদিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সিগনাল না মানা।

তার মতে বাংলাদেশে গত এক যুগে রেলের অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ হলেও এটির নিরাপদ পরিচালনার দিকে খুব একটি খেয়াল করা হয়নি। যার কারণে নতুন ট্র্যাক ও রেলপথ হলেও সেগুলো পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনবল তৈরি হয়নি। একই সাথে নতুন অবকাঠামো তৈরি করা হলেও সেগুলোতে কাজ করার মতো জনবল নিয়োগ করা হয় না।নিরাপত্তার বিষয়ে যাদের বড় ভূমিকা আছে অর্থাৎ স্টেশনমাস্টার, পয়েন্টম্যান, গ্যাংম্যান, সিগনালম্যান ও লোকোমাস্টার বা ট্রেনের চালক..তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।এ কারণে নিরাপদ বাহন হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে রেল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে তিনি জানান।

সূত্র : বিবিসি