অবরোধে রাজধানীর সাথে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

অবরোধে রাজধানীর সাথে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

সংগৃহীত

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ডাকা অবরোধের প্রথম দিনে ঢাকা থেকে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। জামায়াত নেতাকর্মীরা রেলপথ অবরোধ করলেও কিছু ট্রেন চলাচল করেছে। তবে যাত্রী সংখ্যা ছিল খুবই কম। ঢাকার বিভিন্নস্থানে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের মিছিল, অবস্থান ও সংঘর্ষের কারণে আতঙ্কে সাধারণ মানুষের চলাচল ছিল খুবই কম। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাসার বাইরে বের হয়নি। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে।

পল্টনে দুপুরে আল রাজী কমপ্লেক্সে সরকারপন্থিদের একটি অংশ হামলা-ভাংচুর করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
সকালে মাতুয়াইল ও চাঁনখার পুলে বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে অনেক নেতাকর্মী ও পুলিশ সদস্য আহত হয়। সেখান থেকে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। ভোরে গাবতলিতে অবরোধ কর্মসূচিতে যাওয়ার পথে টেকনিক্যাল মোড় থেকে জামায়াতের মিরপুর থানা আমির আব্দুল মান্নান ভূঁইয়াসহ দু’জনকে আটক করে পুলিশ। অপরদিকে যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলায় শিবিরের ৩ কর্মী আহত হয়। পরে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

অবরোধে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃংখলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে ছিল। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও বিভিন্ন এলাকায় দলীয় কার্যালয় ও মোড়ে মাড়ে লাঠি হাতে অবস্থান নেয়।

অবরোধের প্রথম দিনে পুরো ঢাকায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানবাহনের সংখ্যা খুব একটা দেখা যায়নি, ছিল না চিরচেনা যানজটও। ঢাকার মহাখালী, বনানী, গুলশান, মিরপুর, আদাবর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, গ্রিন রোড, তেজগাঁও, বিজয় সরণী, ফার্মগেট, নাবিস্কো, পান্থপথ, কলাবাগান, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, সংসদভবনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সীমিত সংখ্যক বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যান চলাচল করতে দেখা গেছে।

সকাল ১০টার দিকে মুগদা বিশ্বরোড এলাকায় দেখা যায়, অন্য দিনের তুলনায় খুব কম যান চলাচল করছে। প্রতিদিন এই সময়ে বাসস্ট্যান্ডগুলোতে গাড়ির জটলা দেখা দিলেও তেমনটি দেখা যায়নি আজ। দীর্ঘ সময় পরপর আসছিল গাড়িগুলো।

মুগদা মেডিক্যালের সামনে এক যাত্রী বলেন, অবরোধে একটু তো আতঙ্ক থাকবেই। পল্টনে একটা জরুরি কাজ আছে। কাগজ জমা দিতে হবে। এজন্য আতঙ্ক থাকলেও যাচ্ছি।

একই এলাকার আরেক যাত্রী বলেন, মতিঝিলে অফিস। বেসরকারি চাকরি। হারতাল-অবরোধ যাই হোক। উপায় নেই। যেতেই হবে। আজকে রাস্তায় জ্যাম নেই। তারপরেও ভয় লাগে। যদি কেউ আইসা মাইরা দেয়। এদিকে সড়কে মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খা বাহিনীকে টহল দিতে দেখা গেছে। দফায় দফা র‌্যাবের টহল দেখা গেছে এই সড়কে।

গাবতলি, মহাখালি ও সায়েদবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোন বাস ছেড়ে যায়নি। টার্মিনালগুলোতে সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে রাখা হয়। দুপুরে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা যায় দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়ছে না। ফলে দূরদূরান্তের কোনো যাত্রী বাড়ি যেতে পারছেন না মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে। একই অবস্থা দেখা যায় গাবতলি ও সায়েদাবাদে।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে খুবই কম লঞ্চ ছেড়ে গেছে। যেগুলো ছাড়া হয় তাতেও যাত্রী সংখ্যা ছিল খুবই কম। সকালে সদরঘাট লঞ্চ ঘাটে দেখা যায় অধিকাংশ লঞ্চই নোঙর করা। সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত দু-একটি লঞ্চ চলাচল করলেও বেলা গড়ানোর পর যাত্রী মিলছে না সদরঘাটে। ফলে লঞ্চগুলো শিডিউল ভেঙে দেরি করে ছাড়ছে। অন্যদিকে ঘাটে যেসব যাত্রী রয়েছেন তারা দীর্ঘ অপেক্ষা করায় ভোগান্তিতে পড়েছেন। এদিকে চাঁদপুরগামী লঞ্চঘাটের সব লঞ্চ সরিয়ে রাখা হয়েছে। ঘাটে এমভি ঈগল নামে শুধু একটি লঞ্চ রয়েছে। সেই লঞ্চেও যাত্রীর দেখা নেই। অন্যদিকে ভোলাগামী এমভি ওয়ালিদ লঞ্চ বিকেল ৪টায় ছাড়ার কথা রয়েছে। এ লঞ্চেও আশানুরূপ যাত্রী হয়নি বলে জানিয়েছেন লঞ্চের কর্মচারীরা। ফলে এটিও নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

চাঁদপুরগামী যাত্রী আকতার হোসেন বলেন, ঘাটে এসেছি বেলা ১১টায়। কিন্তু দুপুর সাড়ে ৩টায় এমভি ঈগল-৯ নামে একটি লঞ্চ ঘাটে আছে। এটায় উঠেছি। তবুও এক ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।

লঞ্চ ঘাটের শ্রমিক ফয়সাল বলেন, হরতালের দিনেও টুকটাক যাত্রী ছিল। কিন্ত আজ ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা তবুও যাত্রী আসছে না। সকাল থেকে মাত্র দু’টি লঞ্চ ছাড়ছে।

এমভি ঈগল লঞ্চের কর্মচারী আরিফ হাসান বলেন, যাত্রীর আশায় বসে আছি। অবরোধের কারণে যাত্রী নেই। এখনো লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী হয়নি। টিকিটও বিক্রি হচ্ছে না। ৫০ হাজার টাকা লস দিতে হবে আজ। মানুষ ভয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছে না। লঞ্চ থেকে নেমে বাসায় কীভাবে যাবে সেই ভয়ে আছে।

এ বিষয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, একটা লঞ্চ কমপক্ষে ৩৫০-৫০০ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। সেখানে আজ ২০০ যাত্রী হতে কষ্ট হচ্ছে। এত টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে তো কেউ লঞ্চ চালাবে না।

অন্যদিকে অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেও ট্রেন চলাচল করেছে। তবে ছিল যাত্রী সংকট। কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখা যায়, অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক রয়েছে ট্রেন চলাচল। তবে যাত্রীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় স্টেশনেও যাত্রী কিছুটা কম দেখা গেছে। অনেক আসন খালি রেখেই ট্রেন ছেড়েছে।

এক যাত্রী বলেন, যেহেতু হরতাল-অবরোধ চলতেছে। আতঙ্ক তো কিছুটা থাকবেই। তারপরও জরুরি প্রয়োজনে যেতে হচ্ছে।

অবরোধের প্রথম দিনে বিএনপির উদ্যোগে বিভিন্নস্থানে মিছিল বের হয়। এ সময় দু’টি স্থানে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণের উদ্যোগে বিভিন্নস্থানে সড়ক ও নৌ ও রেলপথ অবরোধ করে নেতাকর্মীরা। গাবতলিতে তাদের পাঁচজন নেতাকর্মী আটক ও তিনজন আহত হয়। আজ রাতেও তারা যাত্রাবাড়িতে সড়ক অবরোধ করে। এছাড়া ১২ দলীয় জোট, সমমনা জোটসহ বিভিন্ন দল অবরোধ পালনে মিছিল-সমাবেশ করে।

অন্যদিকে সকাল থেকে রাজপথে সতর্ক অবস্থানে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কসহ বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায়। অনেক স্থানে লাঠি হাতে মিছিল করতেও দেখা গেছে।

মাতুয়াইলে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ, আটক ৩০ : ঢাকার মাতুয়াইলে পুলিশের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দেশব্যাপী অবরোধের সমর্থনে বাদশা মিয়া রোডে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশ মিছিলে বাধা দিলে সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় দফায় দফায় নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় কিছু দেশীয় বোমা বিস্ফোরিত হয়।
ডিএমপির ডেমরা জোনের সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস জানান, পরে তামিরুল মিল্লাত ও মিন্টু চত্বর এলাকা থেকে ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

চাঁনখারপুলে সংঘর্ষ: রাজধানীর চাঁনখারপুলে বিএনপির সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। দুপুর ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ইটপাটকেলের আঘাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তিন কর্মকর্তা আহত হন।

আহতরা হলেন চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি/তদন্ত) আব্দুল হালিম (৩৮), ওসি (অপারেশনস) জাকির হোসেন (৪১) ও পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শুভঙ্কর রায় (৩৯)। তারা সবাই মুখে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আহত অবস্থায় তাদের তিনজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাসে আগুন : রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভান।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এরশাদ হোসেন বলেন, প্রেসক্লাবের সামনে একটি বাসে আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে দু’টি ইউনিট পাঠানো হয়। তবে কে বা কারা আগুন দিয়েছে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি। আগুনে বাসটির ওপরের অংশ পুড়ে যায়।

পল্টনে আল রাজী কমপ্লেক্সে ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ : রাজধানীর পল্টন এলাকার আল রাজী কমপ্লেক্সে ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় আতঙ্ক সৃষ্টি করতে তারা ককটেল ফোটায় এবং ভবনের সামনে রাখা একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় ওই এলাকায় আতঙ্ক দেখা দেয়। দুপুর দেড়টার দিকে কমপ্লেক্সটিতে অর্ধশতাধিক যুবক ভাঙচুর চালায়। পরে তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেখান থেকে কিছু হটে। তাদের সবার হাতে লাঠি এবং মাথায় হেলমেট ছিল বলে জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, ভাঙচুরকারীরা সরকারদলীয় কর্মী। ভবনটি জামায়াতের এমন অভিযোগে সেই ভবনে হামলা চালানো হয়।