নববর্ষ উদযাপনে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয়

নববর্ষ উদযাপনে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয়

সংগৃহীত

নববর্ষ বা থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন ও শুভেচ্ছাবার্তা জানানো ইসলামপরিপন্থী একটি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি না রাসূল সা:-এর যুগে ও সাহাবি রা:-এর যুগে এবং তাবেয়ি রহ:-এর যুগে ছিল কিংবা অন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে ছিল। অথচ তৎকালীন সময়ে ইসলাম ইরান, ইরাক, মিসর, শাম ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো সমৃদ্ধশীল দেশগুলোতেও বিস্তার লাভ করেছিল। এটি এমন একটি বিষয়, যা প্রত্যেক বোধসম্পন্ন ব্যক্তি স্বীকার করতে বাধ্য। তাহলে আজকের মুসলমানরা এই প্রথা কোত্থেকে পেলো? কারাই বা এই প্রথার প্রবর্তক? কোন জাতি বা সম্প্রদায় এই নববর্ষ উদযাপন করে এবং কেন? এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের করণীয় কি হওয়া উচিত?

পৃথিবীর সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ে উৎসব উদযাপন ও আনন্দ-উল্লাস করার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। প্রত্যেক উৎসবের কোনো না কোনো প্রেক্ষাপট রয়েছে এবং প্রতিটি উৎসবে বিশেষ কিছু বার্তাও থাকে। কোনো উৎসব ভালো কর্মের প্রতি অনুপ্রেরণা জোগায় আবার কোনো উৎসব মন্দ কর্মের দিকে ধাবিত করে। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনিষ্টতার ছোঁয়া লাগার কারণে তাতে এমন সব বিদয়াত ও ভ্রষ্টতা ঢুকে পড়েছে যে তার মূল উদ্দেশ্যই হারিয়ে গেছে। পৃথিবী যত উন্নত ও সমৃদ্ধের পথে এগোচ্ছে, মানুষদের কৃষ্টি-কালচার ও শিল্প-সংস্কৃতিতে ততই রকমফের উৎসব এবং আনন্দ-উল্লাসের মহড়া প্রকাশ পাচ্ছে। তেমনি একটি উৎসব হলো নববর্ষ বা থার্টি ফার্স্ট নাইট।

মূলত এই নববর্ষ উদযাপন খ্রিষ্টানদের নব্য আবিষ্কৃত এক ফিতনা। খ্রিষ্টধর্মে নববর্ষ উদযাপনের প্রথা সেই পুরনো যুগ থেকেই চলে আসছে। এর একটি কারণ উল্লেখ আছে যে, তাদের মতাদর্শ মতে ২৫ ডিসেম্বরে হজরত ঈসা আ: জন্মগ্রহণ করেন। সেই খুশিতেই তারা ক্রিসমাস উদযাপন করে। যার কারণে পুরো পৃথিবীতে উৎসবের এই প্রথা চলমান। আর এই প্রথা নববর্ষের দিন পর্যন্ত চলতে থাকে।

নববর্ষ উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান রঙ-বেরঙের সাজ-বাতি ও লাইটিং দিয়ে সুসজ্জিত করা হয় এবং ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকে। ঠিক যখনই ১২টা বাজে তখন একে অপরকে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। কেক কেটে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। আকাশ-পাতাল হ্যাপি নিউ ইয়ার ধ্বনিতে ভারী করে তুলে। আতশবাজি ও ফাটকাবাজিতে চারদিক মুখর করে তুলে। এমনকি বিভিন্ন নাইট ক্লাবে রঙ্গমঞ্চের আয়োজন করে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো- খ্রিষ্টানদের মতোই আমরাও আজ নববর্ষ উদযাপনের জন্য মুখিয়ে থাকি। ৩১ ডিসেম্বরের অপেক্ষায় আমরা প্রহর গুনতে থাকি। হায়রে মুসলমান! আজ আমরা নিজেদের মর্যাদা ও সম্মানকে হীন ও হেয় মনে করে বিধর্মীদের নববর্ষকে সাদরে গ্রহণ করেছি। আজ মুসলমানরা ভুলে গেছে নিজেদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস। অথচ মুসলমানদের ইতিহাস হলো কত সমৃদ্ধ ও উন্নত। মুসলমানদের ইতিহাসে নিজেদের আরবি নববর্ষ আছে, যা রাসূল সা:-এর হিজরত দ্বারা প্রমাণিত। যে নববর্ষ মহররম মাস থেকে শুরু হয়। আর এটিই হলো ইসলামী ক্যালেন্ডার। তা আমরা আজ ভুলে গেছি। ছুড়ে ফেলে দিয়েছি নিজেদের ইসলামী কালচারকে। সাদরে গ্রহণ করেছি বিধর্মীদের উৎসব ও কালচার। আহ! বড়ই অনুতপ্ততা ও লজ্জার বিষয়।

আজ মুসলমানরা ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করে। তারা কি ভুলে গেছে যে, এই নববর্ষের আগমনে তার জীবন থেকে আরো একটি বসন্ত ফুরিয়ে গেল? জীবন থেকে একটি বছর পার হওয়া মানে কবরের খুব কাছাকাছি হওয়া। এ জীবন তো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে দেয়া এক মহা মূল্যবান সম্পদ। এ মহা মূল্যবান সম্পদ বিদায় নেয়ার মানে এটি নয় যে, তার বিদায় উদযাপন করা; বরং আফসোস ও অনুতপ্ত হওয়া।

একটি বছরের আগমনে আরেকটি বছরের সমাপ্তি ঘটে। এই সমাপ্ত বছর আমাদের অনেক বার্তা দিয়ে যায়। অনেক কিছু ভাবতে শেখায়। তিক্ত অভিজ্ঞতা, সুখময় সব স্মৃতি, দুঃখ-বেদনার ঘটনাসমূহ আমাদেরকে উপহার দিয়ে সে বিদায় নেয়। সব মানুষকে স্বীয় জীবনের হিসাব-নিকাশ করার সময় এসেছে, এই বার্তা দিয়ে সে আল-বিদা জানায়। বছরের পরিসমাপ্তি মানে ক্ষণস্থায়ী জীবনের একটি বসন্ত শেষ হওয়া আর মানুষও তার আসল গন্তব্যে ক্রমেই এগিয়ে চলে। কবি বলেন-
দ্যাখো হে গাফেল! সময় বয়ে যায়,

কেমনে, কিভাবে তোমার জীবন গড়ায়।
শায়খ আবুল হাসান আলি নদভি রহ: তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘কিমাতুজ জামান ইনদাল উলামা’-তে লিখেছেন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, আমি কোনো জিনিসের প্রতি এতটা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হই না, যতটা দিনের যবনিকাপাতে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হই। কারণ একটি দিনের পরিসমাপ্তি মানে আমার এক দিন কমে যাওয়া এবং সে দিনে আমার আমল বৃদ্ধি না পাওয়া (পৃষ্ঠা নং-২৭)।
হজরত হাসান বসরী রহ: বলেন, হে আদম সন্তানরা, তোমরা তো হলে সময়ের সমষ্টি। যখন এক দিন অতিবাহিত হয়ে যায় তখন মনে করো যে, তোমাদের একটি অংশও চলে গেছে (প্রাগুক্ত)।

আমাদেরকে যে সময় আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন তা কেবল আখিরাতের প্রস্তুতির জন্যই দান করা হয়েছে। যাতে করে আমরা আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে পারি এবং নিজেদের আমলকে পরিশুদ্ধ করে পারি।

হজরত আলী রা: বলেন, সময় হলো তোমাদের জীবনের পাণ্ডুলিপি। তোমরা এই পাণ্ডুলিপি নিজেদের ভালো কর্মের মাধ্যমে পূরণ করো (আনমুল হিরে, পৃষ্ঠা-১৬, মাতায়ে ওয়াক্ত আওর কারওয়ানে ইলম, পৃষ্ঠা-৫৫)।

নবীজি সা: বলেন, ‘মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য (অর্থাৎ তার উত্তম মুসলিম হওয়ার একটি চিহ্ন) হলো অনর্থক (কথা ও কাজ) বর্জন করা’ (তিরমিজি-২৩১৭)।
আমরা মুসলমান। আমাদের স্বতন্ত্র চেতনা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আছে স্বকীয় ক্যালেন্ডার। বিধর্মীয় বর্ষপূর্তিতে আমাদের এমন উদযাপন স্বধর্মের চেতনাবিরোধী। আর নতুন বছরের আগমনে খুশি কেন হবে? এতে আনন্দের কী আছে? জীবনের মূল্যবান সময়ের মধ্য থেকে একটি বছর শেষ হয়ে গেল সে জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়া উচিত। অতীত হয়ে যাওয়া বছরে আমি কী অর্জন করেছি আর কী হারিয়েছি? পরকালীন জীবনের কী প্রস্তুতি নিয়েছি? কারণ নতুন বছরের আগমন মানে তো পরকালের যাত্রা আরেকটু ঘনিয়ে এসেছে। বছরের বিদায়ান্তে একজন সত্যিকার মুসলিম-হৃদয়ে এমনি ভাবনা ও চেতনা আসা উচিত। অতীত বছরের ভালো-মন্দের হিসাব কষে নতুন বছরের পরিকল্পনা করা উচিত। নিজের ধর্মীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে বিধর্মীয় সংস্কৃতিতে জড়িয়ে নিজের পরকালকে ধ্বংস করা উচিত নয়।

লেখক : আসআদ শাহীন

 অনুবাদক, গবেষক, শিক্ষার্থী, উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগ