ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ও পতন যেভাবে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ও পতন যেভাবে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ও পতন যেভাবে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা সিপিআইএম ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৭৭ সালে। এটি ছিল সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো কমিউনিস্ট সরকার, যারা ক্ষমতায় ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। তারা ক্ষমতায় ছিল একটানা ২০১১ সাল পর্যন্ত।

এই দলটির উত্থান ও পতন প্রত্যক্ষ করেছেন এই দলেরই একজন নেতা মহম্মদ সেলিম। সিপিআইএম যখন ক্ষমতায় আসে সে সময় তিনি এই রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন।মি. সেলিম বলছেন যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল তার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর পরই লোকজন আনন্দে ফেটে পড়েছিল। যেন একটা বিপ্লব ঘটে গেছে।

“রাজ্যের সব এলাকায় সব রাস্তায় লালবাতি জ্বালিয়ে লোকেরা উৎসব করছিল। রাতারাতি কলকাতা হয়ে গেল লাল রঙের শহর,” বলেন তিনি।পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টি যখন তার শাসন শুরু করে তখন মহম্মদ সেলিমের বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। সেসময় এই শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৭০ লাখের মতো।

যেভাবে বদলে গেল হাওয়া

তিনি সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা স্মরণ করছিলেন। বলছিলেন তার কাছে যেন এটা সে দিনের ঘটনা..“হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। সারা রাত ধরে উৎসব চলল। বহু মানুষ যারা রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন নন, তারাও জানতে পারলো যে হাওয়া বদলে গেছে। নতুন কিছু এসেছে।”

“আমার মা-ও বললেন, প্রত্যেক পাঁচ বছর পরে পরেই তো নির্বাচন হয়, কিন্তু কী এমন ঘটেছে যে তোমরা এভাবে উৎসব করছো? রাস্তায় এতো মানুষ কেন? আমি তাকে বললাম- আমরা নতুন ধরনের স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে,” বলেন তিনি।পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম ক্ষমতায় আসার দু’বছর আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এর ফলে নাগরিকদের সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায়।এর জের ধরে কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। মোহাম্মদ সেলিমের মতো তরুণরা উপলব্ধি করেন যে স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য তাদেরকে এখনই উঠে দাঁড়াতে হবে।

তিনি বলেন, “জরুরি অবস্থা জারি করা না হলে আমি ও আমার মতো লোকেরা সম্ভবত রাজনীতিতে যোগদান করতো না।""মিসেস ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন। এর ফলে আমাদের মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হতে লাগলো। বিরোধী নেতাকর্মীদের জেলবন্দী করা হলো এবং পুরো রাজ্যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অনুমতি ছিল না।”

কেন এই জনপ্রিয়তা

উনিশশো সত্তরের দশকে বিশ্বের অনেক দেশেই সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল - বিশেষ করে চীন, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বেশির ভাগ এলাকায়।কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থার মূল মন্ত্র ছিল বৈষম্য দূর করে সমাজের সর্বস্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা, যা দারিদ্র-পীড়িত স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে।

এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ছিল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। নেহরু ও গান্ধীর এই রাজনৈতিক দলটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু মহম্মদ সেলিম বলছেন কংগ্রেসর দীর্ঘ শাসনের পর লোকজন বুঝতে পারলো যে তাদের জীবনে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।তিনি বলেন, এক সময়ের সমৃদ্ধ শহর কলকাতাতেও তখন মানুষের জীবন মানের অবনতি ঘটছিল। লাখ লাখ মানুষ শুধু বেঁচে থাকতেই হিমসিম খাচ্ছিল। গ্রামীণ এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীই তখন ভোটের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে।

“কমিউনিস্ট পার্টি যখন বাংলায় ক্ষমতায় আসে, সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২৮ শতাংশ। এবং ২০১১ সালে আমরা যখন ক্ষমতা ছেড়ে দেই, সেসময় এই রাজ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় একশো শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।”“বাংলায় ৩৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্রসীমার নিচ থেকে উপরে টেনে তোলা হয়েছিল। আমরা লোকজনকে ধনী করিনি, কিন্তু আমরা তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করেছি,” বলেন তিনি।

“আমরা সেতু ও সড়ক নির্মাণ করে সমগ্র বাংলায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছি যাতে যেকোনো জায়গার ফসল বাজারে পৌঁছে যেতে পারে। এর ফলে গ্রামীণ জনগণ সম্পদশালী হতে থাকে। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে লাখ লাখ ডলার মূল্যের জমি রাতারাতি ভূমিহীন দরিদ্র শ্রমিক ও জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হয়।”

জনপ্রিয়তায় ধ্বস

এই নীতির ফলে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকে কয়েক দশক। কিন্তু এক সময়ে ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা কমে যেতে শুরু করে। এবং ২০১১ সালের রাজ্য ও স্থানীয় নির্বাচনে তাদের বড় ধরনের পরাজয় ঘটে।মহম্মদ সেলিম বলেন এই ফলাফলের ব্যাপারে তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।

“আমি ছিলাম পার্টির সদর দপ্তরে। দুপুরের দিকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এই ফলাফলই প্রত্যাশিত ছিল। কারণ এই পরাজয় শুরু হয়েছিল ২০০৮ সাল থেকে।""সেসময় স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল, ২০১০ সালে হয়েছিল কলকাতা পৌরসভা নির্বাচন। এই দুটো নির্বাচনেই আমাদের পরাজয় ঘটে। ফলে ইঙ্গিতটা সেখানেই ছিল।”কিন্তু দলের এই সমস্যা সমাধানে তখন কী কিছু করা হয়েছিল?তিনি বলেন ৩৪ বছর ধরে কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে, ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তা স্বাভাবিকভাবেই কমতে শুরু করে।

“এই দীর্ঘ সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ কমতে থাকে। আমাদের পরাজয়ের পেছনে কিছু রাজনৈতিক ত্রুটিরও ভূমিকা ছিল। আমরা শিল্পায়নের পথে গিয়েছিলাম, যা অপরিহার্য ছিল।""আমরা তখন গ্রামীণ কৃষিখাতে কিছু সংস্কার-কাজ হাতে নিই। কারণ শিল্প ছাড়া, আধুনিক ও বৃহৎ শিল্প ছাড়া আমরা টিকে থাকতে পারবো না,” বলেন তিনি।রাজনৈতিক পরিক্রমায় সিপিআইমের এসব ভুল কি ধরা পড়েছিল? তিনি কি সেগুলো দেখতে পেয়েছিলেন?

“আপনি যখন বিশেষ কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে যাবেন, বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটাবেন, এজন্য জনগণকেও প্রস্তুত করতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে তাদের ভালোর জন্যই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু তখন এসবের বিরোধিতায় সবাই একত্রিত হয়েছিল।”তিনি আরও বলেন, “আমরা যা করতে চেয়েছিলাম, এবং আমরা যা করেছি সেগুলো ঠিক মতো প্রচার করা হয়নি। কিন্তু বিরোধীরা কমিউনিস্টদের ব্যাপারে জনগণের সামনে যেসব সমালোচনা তুলে ধরলে সেগুলো জনপ্রিয়তা পেল।”

“বিরোধীরা বললো যে কমিউনিস্টরা সহিংস দল, তারা চীনের এজেন্ট, তারা রাশিয়ার এজেন্ট অথবা তারা ধর্মের বিরোধী, জাতপাতের বিরোধী। ভারতের মতো একটি দেশে লোকজন এসব বিষয়ে খুব আবেগপ্রবণ। ফলে একটা বিভাজনের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামনে চলে এলো। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এসব যুদ্ধে হেরে গেছি,” বলেন মহম্মদ সেলিম।তিনি বলেন, “কংগ্রেস এবং বিজেপি – এই দুটো দলই এসব ইস্যু ব্যবহার করলো। ফলে লোকজন জমি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এসব বিষয়ের পরিবর্তে মন্দির ও মসজিদ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো। রাজনীতির পুরো বিষয়টিই তখন বদলে গেল।”

পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ভবিষ্যৎ

কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে বিশ্বে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি কি কোনো শিক্ষা নিয়েছে? আগামীতে তারা কি কখনও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে?

মহম্মদ সেলিমের উত্তর: “আমাদের নেতা ও সমর্থকদের একটি বিশাল অংশ এই পরাজয় বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সরকার যখন বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে চাইল, লোকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট হলো, শিল্পায়ন ঘটাতে চেষ্টা করলো, তখনই এই সরকার পরাজিত হলো। কিন্তু যারা শিল্পায়নের বিরোধিতা করলো, যারা কলকারখানা ধ্বংস করে দিল, তারাই নির্বাচিত হলো।”তাহলে পশ্চিমবঙ্গে এখন কাস্তে-হাতুড়ি-তারার (সিপিআইএমের নির্বাচনী প্রতীক) ভবিষ্যৎ কী?মি. সেলিম বলেন, হাতুড়ি ও কাস্তে লোহা দিয়ে তৈরি। এবং এই দুটো কর্মজীবী মানুষের হাতিয়ার। ফলে যতদিন কৃষকরা থাকবেন ততদিন তাদের এই কাস্তের প্রয়োজন। যতদিন শ্রমিকরা থাকবেন ততদিন তাদের হাতুড়ির দরকার।

“মানুষ যতোই দুঃখ দুর্দশার শিকার হবে- হোক সেটা শিক্ষায়, বেকারত্ব, অথবা স্বাস্থ্য খাতে, হোক উন্নয়নের অভাব, জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি- বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানির, তখন তাদের মৌলিক অধিকারের কথা মনে পড়বে,” বলেন তিনি।পশ্চিমবঙ্গে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার নেতা মহম্মদ সেলিম বিবিসিকে বলছিলেন যে তারা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।“আমরা ক্রমশই আন্দোলন গড়ে তুলছি, তরুণদের বিশাল একটি দল হাতে লাল পতাকা এবং কাঁধে কাস্তে ও হাতুড়ির প্রতীক নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে,” বলেন তিনি।

সূত্র :  বিবিসি