ভারতে তিস্তার গতিপথ কি বদলাচ্ছে, জানতে সমীক্ষা

ভারতে তিস্তার গতিপথ কি বদলাচ্ছে, জানতে সমীক্ষা

তিস্তা নদী

সিকিমের সাউথ লোনাক হ্রদের পানি উপচে পড়ে তিস্তা নদীতে গত বছর চৌঠা অক্টোবর যে ভয়ঙ্কর আকস্মিক বন্যা নেমে এসেছিল, তারই জেরে পশ্চিমবঙ্গের সমতল অঞ্চলের কয়েকটি জায়গায় নদীটি গতিপথ বদল করেছে বলে রাজ্য সেচ দপ্তরের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে।

আকস্মিক সেই বন্যায় নয় জন সেনা সদস্যসহ অন্তত ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা আগেই জানিয়েছিলেন যে ওই পাহাড়ি বন্যার ফলে তিস্তার পাড় ভেঙ্গে চুংথামের অনেকটা অঞ্চল জলের তলায় চলে গেছে।এখন সমতল এলাকাতেও সেরকমভাবেই গতিপথ নদীটি তার বদলিয়েছে কি না, সেটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সেচ দপ্তরের সূত্রগুলো বলছে তিস্তা যেখানে পাহাড় থেকে নেমে সমতলে পড়ছে, সেই সেভক থেকে মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত পুরো এলাকাতেই প্রাথমিক সমীক্ষা করেছেন তারা। ড্রোন উড়িয়েও দেখা হয়েছে নদীর বর্তমান গতিপথ।এই তথ্যের সঙ্গে চৌঠা অক্টোবরের আগেকার তথ্য মিলিয়ে দেখে কিছু জায়গায় তিস্তার গতিপথ বদলেছে বলেই তাদের মনে হচ্ছে।গজলডোবাতে যেমন তিস্তার যে দিকে নৌকাবিহার করানো হতো পর্যটকদের, সেখানে জলের অভাবে নৌবিহারের জায়গা সরিয়ে নিতে হয়েছে।

বিজ্ঞানীদের দিয়ে সমীক্ষার নির্দেশ

রাজ্যের সেচ মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, "আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা প্রাথমিকভাবে দেখে মনে করছেন কয়েকটি জায়গায় তিস্তার গতিপথ সরে গেছে। তবে আমরা এখনই নিশ্চিত করছি না বিষয়টা। বিস্তারিত সমীক্ষার জন্য রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে দায়িত্ব দিয়েছি। সেখানকার বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে আমাদের জানাবেন।"

মন্ত্রী মি. ভৌমিক জানিয়েছেন যে কিছু জায়গায় তিস্তার পাড় ভেঙ্গেছে। সেই সব এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে যেরকম যা প্রয়োজন সেরকম ব্যবস্থা নিতে তিনি দপ্তরের প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিয়েছেন।অক্টোবর মাসের ওই আকস্মিক বন্যায় বিপুল পরিমাণ পলিমাটি ভেসে এসেছিল। জলপাইগুড়ি আর আলিপুরদুয়ার জেলা দুটিতে সেই পলি তিস্তার নদীবক্ষে জমা হয়েছে বলেও জানাচ্ছে সেচ দপ্তরের সূত্রগুলি।ওই সূত্রগুলি বলছে সীমান্তের এদিকে যদি তিস্তার গতিপথ কিছুটা বদল করে থাকে, তাহলে বাংলাদেশেও একই ঘটনা হয়ে থাকতে পারে।

তবে উত্তরবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক সুবীর সরকার বলছেন, তিনি এখনও বিজ্ঞানসম্মত তথ্য হাতে পাননি, তবে তিস্তার মতো পাহাড়ি নদীতে অল্পস্বল্প জলধারা বদলানো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।"তিস্তা একটা পাহাড়ি নদী, তার দুদিকে উঁচু ডাঙ্গা জমি। এইসব নদীর ক্ষেত্রে যেটা হয় কখনও কখনও জলের ধারা ডানে বা বাঁদিকে বইতেই পারে। এটাকে গতিপথ বদল বলাটা উচিত হবে না। এটাকে গতিপথের সুইং বলা হয়। যদিও আবারও বলি, সেচ দপ্তরের তরফে যেটা বলা হচ্ছে, তার বিজ্ঞানসম্মত তথ্য এখনও আমি হাতে পাইনি," বলছিলেন অধ্যাপক সুবীর সরকার।

'১৭৮৭ সাল থেকে নতুন খাতে বইছে তিস্তা'

তিস্তা একসময়ে গঙ্গায় এসে মিশতো যেত বলে জানা যায়। পুরানো একটি মানচিত্র, যা ১৭৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানেও দেখা যায় যে তিস্তা দক্ষিণমুখী নদী।

"তবে ১৭৮৭ সালের বন্যার পর থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে সম্পূর্ণ নতুন খাতে সরতে শুরু করে তিস্তা। নতুন খাতে গঙ্গার বদলে তিস্তার জল ব্রহ্মপুত্র-মেঘনায় গিয়ে পড়ে এখন। এই যে সম্পূর্ণ অন্যদিকে বইতে শুরু করলো, এটাকে আমরা বলি নদীর গতিপথ বদল। এরপরে ১৯৬৮ সালের উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যার পরে আরও কিছুটা গতিপথ বদলিয়েছে তিস্তা, তবে ১৭৮৭ র মতো সম্পূর্ণ নতুন খাত নয় সেটি," বলছিলেন অধ্যাপক সুবীর সরকার।

ভারতের তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেল মেজর জেমস রেনল্ডের তত্ত্বাবধানে তৈরি মানচিত্র আর পুরানো নথি ঘেঁটে এইসব তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।"সিকিম থেকে নেমে আসার পরে বর্তমান বাংলাদেশের পাবনার কাছাকাছি কোথাও তিস্তা গঙ্গায় মিশতো বলে জানা যায়," বলছিলেন অধ্যাপক সরকার।

বুকানন হ্যামিলটনের মতো সার্ভেয়ার, যিনি ওই অঞ্চলে যান ১৮৩০-৩৩ সালে, তিনিও যেমন বর্ণনা দিয়েছেন, আবার ১৮১১ সালের প্রথম সার্ভে থেকেও জানা যায় যে তিস্তা তার গতিপথ বদল করছিল।অধ্যাপক সরকারের কথায়, ১৭৮৭ র বন্যা ছাড়াও সেই সময়ে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পও হয়েছিল।এসবের কারণেই তিস্তা সম্পূর্ণ নতুন খাতে চলে যায়।

উপগ্রহ থেকে পাওয়া সিকিমে বদলের চিত্র

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ লেস্টারের গবেষকরা উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে আগেই দেখিয়েছেন চৌঠা অক্টোবরের ওই আকস্মিক বন্যার পরে তিস্তা নদী চুংথাম এলাকা কতটা বদলে দিয়েছে।বন্যার আগে ও পরে নেওয়া দুটি ছবি তারা প্রকাশ করেছে। বন্যার আগে নেওয়া ছবিতে তিস্তা নদীর পাড়ে চুংথাম গ্রাম আর তিস্তা-৩ বাঁধ সবই অটুট আছে দেখা যাচ্ছে।আর লোনাক হ্রদ থেকে পানি উপচে পাহাড়ি বন্যা নেমে আসার পরে ১০ই অক্টোবর নেওয়া উপগ্রহ চিত্রতে দেখা যাচ্ছে বাঁধটি ধ্বংস হয়ে গেছে, অনেক বাড়ি জলের তলায় চলে গেছে। নদীখাতও অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে।

লোনাক হ্রদ ভেঙ্গে যে বন্যা হতে পারে, এরকম একটা সম্ভাবনার কথা আগেই জানিয়েছিলেন গবেষকরা। যে হিমবাহ হ্রদে এসে মেশে, তার বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার কারণে হ্রদটি তিন দশকে প্রায় আড়াই গুণ বড় হয়ে গিয়েছিল।বিবিসির পরিবেশ সংবাদদাতা নবীন সিং খাডকা বলছেন আগে থেকে আশঙ্কা করা হলেও কোনও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়নি সেখানে।

সূত্র :বিবিসি