সংসদ অধিবেশনের কয়েকদিন আগেও যেসব বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা

সংসদ অধিবেশনের কয়েকদিন আগেও যেসব বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা

সংসদ অধিবেশনের কয়েকদিন আগেও যেসব বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি থাকলেও এখনো এই সংসদের বেশ কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে। সংসদের বিরোধীদল কারা হবে সেটি নিয়ে নানা আলোচনা আছে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আদৌ কোনো জোট করবে কিনা, সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের ভাগ-বাটোয়ারাই বা কীভাবে হবে তা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগের বাইরে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে বেশিরভাগই বলছেন, সংসদে বিরোধীদল নয়, বরং আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে অংশ নিতে চান তারা।আগামী রোববার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত এই বৈঠকের পরই বিরোধীদলে কারা থাকছেন সেটি চূড়ান্তভাবে জানা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংসদে জাতীয় পার্টিই বিরোধীদল হবে।

বিরোধী দল কারা হবেন সেটি নির্ধারণ করা স্পীকারের এখতিয়ার হলেও এখনো কোনো দলকে বিরোধীদল হওয়ার আহ্বান জানাননি স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী।আগামী ৩০শে জানুয়ারি বিকেলে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা রয়েছে। গত ১৫ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এই অধিবেশন আহ্বান করেছেন।

 ‘আওয়ামী লীগে থাকতে চাই’

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। নিজ নির্বাচনি এলাকায় আওয়ামী লীগের কমিটিতে পদও রয়েছে এদের অনেকেরই। তাই তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সংসদে আওয়ামী লীগের সাথেই অন্তর্ভুক্ত হতে চান।

রংপুর-৫ আসনে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য জাকির হোসেন সরকার। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, পারিবারিকভাবেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তার নির্বাচনী আসন মিঠাপুকুর উপজেলার আওয়ামী লীগের কমিটিতে গত ৩৭ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি এখনো রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।এ কারণেই সংসদেও তিনি আওয়ামী লীগের সাথেই যুক্ত হতে চান বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “এমপি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, ইন্ডিপেনডেন্ট ক্যান্ডিডেট দাঁড়ালে আমাদের আপত্তি নাই, এবং যারা যেভাবে খুশি নির্বাচন করবে, তো সেই আলোকেই প্রার্থী হয়েছি। বিরোধীদল হতে চাই না।”রংপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আসাদুজ্জামান। তিনিও দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। সংসদে বিরোধী দল নয় বরং আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হতেই বেশি আগ্রহী তিনি।সেক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই মেনে নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

ময়মনসিংহ-৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হয়েছেন এ বি এম আনিসুজ্জামান। সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভার মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি এখনো ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির একজন সদস্য।তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে সংসদেও আওয়ামী লীগেই এমপি হিসেবে ফিরতে চান।

বিবিসি এর আগেও কমপক্ষে আট জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের সাথে কথা বলেছিল, যাদের সিংহভাগই সেসময় জানিয়েছিলেন যে, সংসদে আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবেই যোগ দিতে চান তারা।তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত নন, এমন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অবশ্য বলছেন, তারা কোনো জোট বা আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পক্ষে নন। বরং সাধারণ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই সংসদে থাকতে চান তারা।সিলেট-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়া মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী মূলত ইসলামী ভাবধারার রাজনীতির সাথে জড়িত। আল-ইসলাহ নামে তার একটি দল রয়েছে।

মি. চৌধুরী বলেন, “আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বতন্ত্র স্বকীয়তা নিয়ে থাকাটাই আমার জন্য ভালো।”প্রধানমন্ত্রীর সাথে আসন্ন বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপাতত তিনি সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই থাকতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রী যা বলবেন সেটি বিবেচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাবেন।“উনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে স্নেহ করেন, উনার সামনে গেলে উনি কী নির্দেশনা দেন বা উনার কী অভিমত, সেটি শুনে বিবেচনা করবো।”

জাতীয় পার্টি বিরোধী দল?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর আগে বলেন, স্বতন্ত্রদের আসন যতই থাকুক, দল হিসেবে জাতীয় পার্টির আসন বেশি থাকায় তারাই হবেন বিরোধী দল।তবে এ বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও ঘোষণা আসেনি।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে যেহেতু এখনও পর্যন্ত জানা যাচ্ছে যে, জাতীয় পার্টিই বিরোধী দল হবে, তাই এটির ব্যত্যয় ঘটবে বলে তারা মনে করেন না।

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যকে সামনে এনে বলেন, তিনি যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং মুখপাত্র, এবং তিনি যেহেতু এরইমধ্যে একটি আভাস দিয়েছেন যে, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হবে, তাহলে তাদেরই বিরোধীদল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে বলে মনে করেন তিনি।রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, নামকাওয়াস্তে বিরোধীদল চাইছে আওয়ামী লীগ। আর এর জন্য জাতীয় পার্টিকেই বেছে নেয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তিনি বলেন, “তাদের (আওয়ামী লীগের) জন্য যেটি সুবিধা যে একটি মিউটেড বিরোধী দল কিংবা বিরোধীদলের সমর্থন থাকবে তাদের প্রতি এবং নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল, সে হিসেবে জাতীয় পার্টির দিকেই তাদের মনোযোগ রয়েছে।”স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি কোনো জোট গঠন করে এবং তাদের সংখ্যা যদি জাতীয় পার্টির আসনের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে সংসদের স্পীকার অনুমতি দিলে সেই জোটও বিরোধী দল হতে পারে।

আবু আলম শহীদ খান বলেন, “সংসদে যারা আছেন তারা সবাই একই ছাতার তলের মানুষ। আওয়ামী লীগের ২৪২ জন নৌকা মার্কা নিয়ে জিতেছেন, এর বাইরে ৬০ জন তারা অন্য মার্কা নিয়ে জিতেছেন কিন্তু তারা আওয়ামী লীগেরই অংশ, ১৪ দলের যে ক’জন জিতেছেন, তারা নৌকা মার্কা নিয়েই জিতেছেন। এর বাইরে জাতীয় পার্টি সিট অ্যাডজাস্টমেন্টের মধ্য দিয়ে এসেছে। এটা একটা দলের সংসদ।”তাই এই সংসদে বিরোধীদলের বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্ব পাবে সেটা ‘ভাবনার বিষয়’ বলে মনে করেন মি. খান।

স্বতন্ত্রদের ভূমিকা কেমন হবে?

আওয়ামী লীগের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সংসদের মোট ৬০টি আসন পেয়েছেন তারা।এতো সংখ্যক আসন পেলেও তারা কোনো জোট গঠন করার ঘোষণা এখনও দেননি।আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই এখনো আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটির পদে রয়েছেন। তারা দলের পদ ছাড়েননি এবং ছাড়তে চানও না। তারা দলের সাথেই যুক্ত হতে চান বলেও জানিয়েছেন।

তাই তারা আলাদা একটি জোট বানাবেন এমন সম্ভাবনাও কম বলে মনে করেন মি. খান।তিনি বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দেন তাহলে তাদের উপর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে।এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নিজ দলের বাইরে গিয়ে ভোট দিলে ‘ফ্লোর ক্রসিংয়ের’ অভিযোগে তার সদস্য পদ বাতিল হওয়ার নিয়ম রয়েছে।তবে তারা যদি স্বতন্ত্র এমপি হিসেবেই থেকে যান তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর হবে না। সেক্ষেত্রে তারা কিছু কিছু বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারবেন।

“সেখানেও বটম লাইন (মূল কথা) হচ্ছে, তারা কতটা খোলা-মেলা কথা বলবেন এবং সেই খোলা-মেলা কথাও কতটা গ্রহণযোগ্য হবে,” বলেন মি. খান।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের ছায়া প্রার্থী। তাদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে নির্বাচন করার জন্য।কাজেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিরোধী দলে যাবে বা যেতে পারবে বলে মনে করেন না তিনি।মিজ নাসরীন মনে করেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভূমিকাটা থাকবে আওয়ামী লীগের পক্ষেই। তাদের কোনো বিরোধিতা থাকবে না।

সংরক্ষিত নারী আসনের ভাগাভাগি কীভাবে হবে?

জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলে তারা যেহেতু সংসদে ১১টি আসনের দখলে থাকবে, তাই তারা সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনেও খুব বেশি ভাগ পাবেন না। এক বা দুটি আসন তারা পেতে পারেন।

স্বতন্ত্র এমপিরা যদি কোনো জোট গঠন না করে, তারা যদি স্বতন্ত্র হিসেবেই থেকে যান তাহলে তারা সংরক্ষিত নারী আসনের ভাগ পাবেন না। এই আসনের ভাগ পেতে হলে তাদের জোট অবশ্যই গঠন করতে হবে বলে জানান আবু আলম মো. শহীদ খান।আর যদি এই এমপিরা আওয়ামী লীগে যোগ দেয়, তাহলে আওয়ামী লীগের মোট আসন আরো বেড়ে যাবে এবং সংরক্ষিত নারী আসনের প্রায় সবকটিই তাদের ভাগে থাকবে।সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি বিরোধীদল হলেও তাদের আসন সংখ্যা থাকবে গুটি কয়েক মাত্র।

মি. খান বলেন, আসন সংখ্যাটাও যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির অতীত ইতিহাসও খুব একটা জোরালো নয়। গত দুই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলেও তাদের ভূমিকার কারণে তারা ‘গৃহপালিত বিরোধীদলের’ তকমা পেয়েছে।“বিরোধীদল হিসেবে যে রোল প্লে করার কথা, তারা সেটা কখনোই রাখেনি। তাই এগারো জন নিয়ে তারা কী ভূমিকা রাখবেন, সেটা দেখার বিষয়। কিন্তু তারা তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা রাখবেন বলে আমি মনে করি না।”সংরক্ষিত নারী আসনের ভাগ-বাটোয়ারায় জাতীয় পার্টিকে এক-দুইটি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে মিজ নাসরিনও।

কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির ২৬টি আসনে সমঝোতা হলেও শেষমেশ তারা ১১টি আসন পেয়েছে। তাই সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে মনে করেন তিনি।“এখানে আওয়ামী লীগ তাদের জায়গা থেকে ছাড় দিয়ে জাতীয় পার্টিকে সংরক্ষিত নারী আসন বেশি দিবে-এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই।”“কারণ জাতীয় পার্টির রাজনীতি এখন অনেকটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির ওপর নির্ভর করছে”, বলেন মিজ নাসরীন।

সূত্র : বিবিসি