যে উপহারে মৃতরা খুশি হয়

যে উপহারে মৃতরা খুশি হয়

ছবি: সংগৃহীত

মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করেন, কবরের জীবনে শান্তি কিংবা শাস্তি আছে। নেক আমলের কারণে সুখ-শান্তি আর বদ আমলের জন্য শাস্তি হবে। এমন কিছু আমল এমন আছে, যার সওয়াব মৃতরা কবরে পায়। বদ আমলের ব্যাপারও অনুরূপ। মৃতদের উদ্দেশে জীবিতদের কৃত আমলের সওয়াব কবরে পৌঁছে, যা কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তবে প্রচলিত কুলখানি, চল্লিশা ও তিন দিনের মিলাদ ইত্যাদি নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত ও আলোচনা।

মৃতদের উপমা ও অপেক্ষা : ব্যক্তির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যক্তিগত নেক আমলের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ মৃতরা নেক আমলের প্রতি বেশি মুখাপেক্ষী থাকেন। কারণ কবর জীবনে মানুষের দুটি জিনিস সঙ্গে থাকে, নেক আমল এবং বদ আমল। বদ আমল শাস্তির কারণ। আর শাস্তি থেকে পরিত্রাণের উপায় নেক আমলের আধিক্য। কিন্তু কবরের জীবনে তো নিজের কোনো আমল করার ক্ষমতা নেই। তাই মৃতরা জীবিতদের সাহায্যের প্রতি উন্মুখ থাকে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) নবী কারিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, কবরে মৃতদের উপমা হলো ডুবন্ত সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তির মত (যে পানিতে ডুবতেছে আর বাঁচার জন্য অন্যের কাছে সাহায্য চাচ্ছে)। তারা বাবা-মা, ভাই-বোন, অন্তরঙ্গ বন্ধু কিংবা নেক-সন্তানের দোয়ার অপেক্ষা করে। (শোয়াবুল ইমান : ৭৯০৫)

মৃতদের কাছে সওয়াব পৌঁছানো : মৃতদের কাছে কি সওয়াব পৌঁছানো সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। তাদের উদ্দেশে করা আমাদের ইবাদতের সওয়াব তাদের কাছে পৌঁছে, এ মর্মে হাদিস আছে। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মা-বাবা আপনার ওপর কোরবান হোক! আমরা মৃতদের জন্য দোয়া করি, সদকা করি, হজ ইত্যাদি পালন করি। এগুলো কি তাদের পর্যন্ত পৌঁছে? নবীজি (সা.) বললেন, হ্যাঁ। এগুলো তাদের পর্যন্ত পৌঁছে এবং এগুলোর কারণে তারা ততটাই খুশি হয়, যতটা আমরা উপঢৌকন পেলে খুশি হই। (হাদিয়াতুল ইহইয়া : ৮)

অন্য বর্ণনায় আছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবীজিকে বললেন, তার মা ইন্তেকাল করেছে। এখন তার পক্ষ থেকে সদকা করলে কি তিনি উপকৃত হবেন? নবীজি বললেন, হ্যাঁ। (সহিহ বোখারি : ১৩৮৮)

যে উপঢৌকনে মৃতরা খুশি হয় : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদা নবীজি (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা মৃতদের হাদিয়া দাও। আমরা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! মৃতদের কী উপঢৌকন দেব? নবীজি (সা.) বললেন, সদকা ও দোয়া।

জীবিতদের দেওয়া এমন সদকার কারণে মৃতরা অসম্ভব খুশি হয়। নবী কারিম (সা.) বলেন, এসব আমলের হাদিয়া তাদের কাছে দুনিয়া এবং দুনিয়ার সব সম্পদের থেকেও অধিক প্রিয়। জীবিতদের উচিত মৃতদের জন্য বেশি বেশি হাদিয়া প্রেরণ করা।

সন্তানের দোয়ায় পিতামাতার মর্যাদা বাড়ে : কবরবাসী পিতামাতার জন্য সন্তান দান-সদকা ও দোয়া করলে তাদের সম্মান ও মর্যাদা বাড়ে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, জান্নাতে ব্যক্তির মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করা হলে তিনি বলবেন, ইয়া রব! এটা কি আমার জন্য? আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ, এটা তোমার জন্য; তোমার সন্তানের ইস্তেগফারের ফল। (হাদিয়াতুল ইহইয়া : ১২)

মৃতদের কবরের আজাব মাফের কারণ : জীবিতদের পক্ষ থেকে মৃতদের জন্য করা দান-সদকার কারণে তাদের কবরের আজাব মাফ করা হয়। হজরত ওকবা ইবনে আমের (রা.) নবী কারিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, দান-সদকা কবরের বাসিন্দাদের থেকে গরমের প্রচ-তাকে দূর করে। আর মুমিন ব্যক্তি কেয়ামতের দিন স্বীয় দানের ছায়ায় আশ্রয় নেবে। (শোয়াবুল ইমান : ৩৩৪৭)

মৃতদের আহ্বান ও অনুরোধ : নবী কারিম (সা.) বলেছেন, মৃত মুমিনদের রুহ প্রতি জুমাবারে প্রথম আসমানে আসে। অতঃপর তারা তাদের বাড়িঘর বরাবর অবস্থান করে এবং আহ্বান করতে থাকে আমার পরিবার, সন্তান, আত্মীয়স্বজন তোমরা কিছু দিয়ে আমাদের ওপর অনুগ্রহ করো। আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। আমাদের স্মরণে রেখো, ভুলে যেও না। আমাদের অসহায়ত্বের ওপর দয়া করো। আমাদের জন্য দোয়া-সদকা, তাসবিহ পাঠে কৃপণতা করো না। হয়তো আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন, তোমরা আমাদের মতো হওয়ার আগেই। হে আল্লাহর বান্দারা, আমাদের কথা শোনো, তোমরা জানো, এসব সম্পদ আমাদের মালিকানায় ছিল; যা আজ তোমাদের হাতে। আমরা সেগুলো আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করিনি। ফলে আজ সেগুলো আমাদের মসিবত ও আজাবের কারণ। অন্যের উপকারী হয়েছে আর আমাদের ওপর শাস্তি ও হিসাব অর্পিত হয়েছে। এভাবে তারা হাজারবার আহ্বান করতে থাকে। বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, এরপর নবী কারিম (সা.) এবং আমরা এতটা ক্রন্দন করি যে, আমরা কথা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলি। এরপর নবীজি (সা.) বলেন, এরা তোমাদের ভাই যারা দুনিয়ার নেয়ামতে ডুবে ছিল। এখন তারা ক্ষয়প্রাপ্ত জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে। (হাদিয়াতুল ইহইয়া : ৬)

কুলখানি, চল্লিশা ও তিন দিনের মিলাদ : মৃতদের জন্য দান-সদকা, আমল-ইস্তেগফার করলে সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছানো হয় এবং সেগুলোর কারণে তারা উপকৃত হয়। কিন্তু নবী কারিম (সা.) থেকে এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না, যেখানে বলা হয়েছে যে, এই দোয়া তিন দিনের মাথায় কিংবা চল্লিশ দিনের মাথায় করতে হবে। এমন কথাও নেই যে, কী পরিমাণ দান-সদকা করতে হবে। সমাজে তিন দিন বা চল্লিশা নামে যে প্রচলন রয়েছে, তা ইসলাম সমর্থিত নয়। সমাজ কর্র্তৃক গরিব-অসহায় পরিবারকে পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ চাপে ফেলা, লজ্জা দেওয়া সম্পূর্ণ অনৈসলামিক প্রথা। ইসালে সওয়াব (মৃতদের জন্য দোয়া) ইসলাম যে পদ্ধতিতে করতে বলেছে, সেই পদ্ধতিতে করলে বৈধ হবে, নচেৎ তা অবৈধ। ইসালে সওয়াব দিনসর্বস্ব হওয়া উচিত নয়। বরং প্রতিদিন নিজ পরিবারের লোকদের জন্য ইসালে সওয়াব করা চাই। পরিমাণে অল্প হলেও দান-সদকা ও প্রতিনিয়ত দোয়া-দরুদে তারা যে উপকৃত হবেন, অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়।

মনে রাখতে হবে, শুধু আল্লাহ বিধানমতো ইবাদত করলেই তা ইবাদত বলে বিবেচিত হবে, অন্যথায় তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না।