মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আরো ৬৩ সদস্যের বাংলাদেশে প্রবেশ

মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আরো ৬৩ সদস্যের বাংলাদেশে প্রবেশ

মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আরো ৬৩ সদস্যের বাংলাদেশে প্রবেশ

মিয়ানমার থেকে বুধবার আরও ৬৩ জন বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপি সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এ নিয়ে মিয়ানমার থেকে ৩২৭ জন নিরাপত্তা রক্ষী বাংলাদেশে পালিয়ে আসল।

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির রামু জোনের সেক্ট কমান্ডার মেহেদি হাসান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।সম্প্রতি আরাকান আর্মি ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিয়ানমারের বাহিনীর লড়াই তীব্র হয়ে ওঠার পর সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকেই পালিয়ে ভারতে ও বাংলাদেশে যাচ্ছে। গত তিনদিন বাংলাদেশে তিন শতাধিক সীমান্ত রক্ষী পালিয়ে এসেছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী মন্তব্য করেছেন, মানবিক কারণে ও আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার খাতিরে গত তিন দিনে আড়াইশোর বেশি মিয়ানমার নাগরিককে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে।মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের বিষয়ে বিজিবি মহাপরিচালক বলেছেন, “মানবিক কারণে, আন্তর্জাতিক রীতির কারণে ও সুসম্পর্ক রাখার কারণে আমরা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছি।"

মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সেনা সদস্যদের সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলমান সংঘর্ষের মাঝে বুধবার তিনি সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু ও ঘুমধুম এলাকা পরিদর্শন করেন।এরপর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন।

ঘুমধুম সীমান্তে যা হচ্ছে

বুধবার বিকেল তিনটা নাগাদ ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু গ্রাম থেকে বিবিসি সংবাদদাতা মুকিমুল আহসান জানান, বর্তমানে সীমান্তে গোলাগুলি হচ্ছে না।কিন্তু তারপরও স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক কাজ করছে এবং অনেক গ্রামবাসী বাড়িঘর ছেড়েছে।সাধারণত ঘুমধূমের বাজার অত্যন্ত জনাকীর্ণ থাকলেও এখন অনেকটা ফাঁকা।

মুকিমুল আহসান জানাচ্ছেন, “এখন পর্যন্ত এই গ্রামের অন্তত ১০টা বাড়িতে গেছি আমরা। একেকটা বাড়িতে দুই থেকে তিনটা করে ঘর। কিন্তু সেই ঘরগুলো এখন জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে আছে।”“কোনও কোনও বাড়িতে দুই একটা গবাদি পশু ও সেই বাড়ির পুরুষ সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটার সংখ্যাও খুবই কম। তাদের সাথে কথা বলে জেনেছি, দিনের বেলা কেউ বাড়িতে থাকছে না।”

বিবিসি সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, “এপাশ থেকে মনে হচ্ছে, ওপারের ক্যাম্পগুলো মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে। সেজন্যই সীমান্তের ওপাশে গোলাগুলি হচ্ছে না এবং সবকিছু অনেকটাই শান্ত।”ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান যে সীমান্তের ওপাশে গোলাগুলি বন্ধ হওয়ায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই একটা পরিবার বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।

“চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, আজকে সকালের পর থেকে কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে আবার নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে যাচ্ছে।”তবে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কোনও কোনও পরিবার বাড়ি ফিরে আসছে, তার কারণ হলো আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বা সুযোগ নেই।এছাড়া, সীমান্তের অস্থিরতার জন্য যে পাঁচটি স্কুল বন্ধ করা হয়েছিলো। সেগুলো বন্ধই আছে।

স্থানীয়দের বাড়ি ছাড়ার অনুরোধ

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান আর্মিসহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চলমান লড়াইয়ের কারণে যেন কারও কোনও ক্ষতি না হয়, সেজন্য বিজিবি মহাপরিচালক স্থানীয় জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন।তিনি বলেছেন, “এটা একেবারে বর্ডার সংলগ্ন। আমাদের সাধারণ জনসাধারণের জন্য এই জায়গাটুকু আসলে নিরাপদ নয়। বিশেষ করে যখন গোলাগুলি শুরু হয়, সেই সময়টুকুতে তো একেবারেই নয়।”

তাই, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে বাড়ি ছাড়ারও পরামর্শ দেন তিনি।“এটা স্বাভাবিক যে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকাটা আদৌ সুখকর কিছু না। তবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার্থে কিছুটা তো করতেই হবে,” যোগ করেন তিনি।জানা গেছে, গোলাগুলির ভয়ে ইতোমধ্যে ঘুম ঘুম এলাকার অনেক বাসিন্দা স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।

কতজন পালিয়ে এসেছেন?

আরাকান আর্মিসহ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলা জোরদার হওয়ার পর গত তিনদিন ধরে মিয়ারমার থেকে পালিয়ে আসছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা।

এ পর্যন্ত মোট ৩২৭ জন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপি’র সদস্যকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বুধবার আসা ৬৩ জন বিজিপি সদস্য রয়েছে।বিজিপি সদস্যের বাইরেও আশ্রয় নেয়াদের মাঝে দুইজন নারী ও দুইজন শিশুও রয়েছে।এদের সবাইকে ঘুম ধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। তবে বিজিপি সদস্যদেরকে আশ্রয় দেয়ার আগে তাদেরকে নিরস্ত্র করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি।

গত ছয়ই ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ মঙ্গলবার মিয়ানমার সেনা সদস্যদের সঙ্গে ওখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলমান সংঘর্ষ থেকে প্রাণে বাঁচতে দেশটির মোট ১১৪ জন নাগরিক বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। তবে, তাদের মাঝে ১১০ জনি হলে বিজিপি সদস্য।মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করে গত চৌঠা ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে।

ঐদিন তারা বিদ্রোহীদের তীব্র হামলার মুখে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করেন। এরপর থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।এদিকে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে তীব্র সংঘর্ষের মধ্যে সেখানে চাকমা সম্প্রদায়ের প্রায় চারশো জন এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছু লোক জড়ো হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান। এ অবস্থায় ঐ চাকমা-রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিজিবি যেভাবে সামাল দিচ্ছে

বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ-বিজিবি জানিয়েছে, চলমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসাদের নিরাপত্তা, খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে বিজিবি। এছাড়া, এদের মাঝে যারা আহত অবস্থায় আছে, তাদেরকে চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে।বিজিবি মহাপরিচালক জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে মোট আটজন মিয়ানমার নাগরিক আহত আছে।

“তাদের চারজন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে আছে। বাকী চারজনের জীবন বাঁচানোর জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়েছে।”“গত দুইদিনের তুলনায় আজ গোলাগুলির পরিমাণ একটু কম। এটা যদি আবার বাড়ে, তাহলে এটা কিভাবে কমানো যায়, সেটা আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো,” যোগ করেন তিনি।

 ‘আমরা আর কোনও মৃত্যু চাই না

গত পাঁচই ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেলের আঘাতে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জলপাইতলী সীমান্তে বাংলাদেশি এক নারী এবং একজন রোহিঙ্গা নিহত হন।

এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “এর আগে বিভিন্ন গোলাবারুদ, মর্টারশেল আমাদের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে। একজন রোহিঙ্গাসহ একজন মহিলা আগে মর্টারশেলের আঘাতে মারা গেছে।”“আমরা আর কোনও মৃত্যু চাই না। আমরা এই পরিস্থিতির আশু সমাধান চাই,” বলেন মহাপরিচালক।তিনি জানিয়েছেন, সীমান্তে চলমান অস্থিরতার মাঝে বিজিবিকে ধৈর্য্য ধারণ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিজিবিকে প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনা দিয়েছেন।

মিয়ানমারকে ‘কঠিন বার্তা

মিয়ানমারের নিজেদের গোলযোগের কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল, অর্থাৎ মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।

সেটিকে মনে করিয়ে দিয়ে এদিন মি. সিদ্দিকী বলেন, “গতকাল মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কঠিনভাবে বার্তা দেয়া হয়েছে। এটার জন্য তাদেরকে আমরা প্রতিবাদলিপি দিয়েছি…যাতে কোনও ধরনের গোলাগুলি আমাদের বর্ডারের ভেতরে না আসে।”এরপর থেকে মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাঝে যোগাযোগ হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেন বিজিবি মহাপরিচালক মি. সিদ্দিকী।

“আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে মায়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ হয়েছে। উভয় মন্ত্রণালয়ের মাঝে পত্রালাপ চলছে। যারা আশ্রয় নিতে এসেছে, তাদেরকে তারা নিয়ে যেতে প্রস্তুত।”তিনি বলেন, মিয়ানমারকে দ্রুত তার নাগরিকদেরকে ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মুহাম্মদ মাইনুল কবির মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে প্রতিবাদলিপিটি পেশ করেছিলেন।সীমান্তে চলমান অস্থিরতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের কাছে বাংলাদেশের নিজস্ব সীমানায় গোলা নিক্ষেপের ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ।

পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার দপ্তরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যসহ অন্যান্যদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।”

তিনি বলেন, "মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ আছে। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তাদের সীমান্তরক্ষীদেরও ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।"তার আগের দিন, অর্থাৎ সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, “মিয়ানমার সীমান্তের পরিস্থিতি খুবই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ।”“একইসঙ্গে সীমান্তে সশস্ত্র বাহিনীকে ধৈর্য ধরতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

সূত্র : বিবিসি