যৌতুকের অভিশাপ
ফাইল ছবি
অধ্যাপক ডা. শামছুন নাহার
আদ্-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
কয়েকদিন আগে একটি মেয়ের খবর চোখে পড়ল। সে তার শশুর বাড়িতে রান্না ঘরে রান্না করছিল। তার কাপড়ে আগুন ধরেছে। সে এত চিৎকার চেঁচামেচি করে ডাকাডাকি করেছে কেউ শুনতেই পায়নি। তার স্বামীটি পাশের ঘরে ভাইবোনদের সাথে তাস খেলছিল। যখন ৮০% পুড়ে ছাই হয়ে মৃত্যুর জন্য ভালমতো তৈরি হয়েছে তখন তার শশুর সবাইকে ডেকে বলছে দেখতো কি হয়েছে? চিল্লানো শোনা যায়। বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের কত বড় বাসা হয় যে রান্না ঘরে চিৎকার করলে অন্যঘর থেকে শুনতে পায়না? পেছনে আছে যৌতুকের প্রচ্ছন্ন কাহিনি। ভাল মত তদন্ত করলে হয়তো দেখা যাবে আগে থেকে কেরোসিন ছিটানো ছিল। অনেক কিছুই হতে পারে। তার একটি ছেলে বাচ্চা আছে। মেয়েটা চাকুরী করতো। এই ৮/১০ বছর পুরো টাকাটা স্বামী/শাশুড়ীর হাতে তুলে দিত। তাতে তার অফিসে যাতায়াতের টাকাটাও থাকতো না। হাত খরচ তো দুরের কথা কেবল জুলাই মাসের বেতনটা নিজের কাছে রেখেছিল। তাতেই জীবন দিতে হলো। এই কথাগুলো অফিসের কলিগদের কাছে বলে গেছে। এটা একটা প্রতীকী ঘটনা মাত্র। এমন কত শত ঘটনা চোখের আড়ালে ঘটে যাচ্ছে। সব কিছু তো আর সামনে আসে না। কেবল বাড়াবাড়ি ব্যাপারটাই আমরা জানতে পারি। এভাবে কত নারী, কত নববধু বাংলার আনাচে কানাচে, স্বামী শাশুড়ীর হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে তার হিসেব কে রাখে?
আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ, পোশাক আশাক, চিত্তে বিত্তে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই যৌতুকের কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং নতুন নতুন কৌশলে তাদের উপর নির্যাতন চলছে। হত্যাযজ্ঞ চলছে। কাউকে কাউকে আবার আত্মহত্যার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে মরণ আগিয়ে দেয়া হচ্ছে। সমাজের সকল স্তরের নারীরা শশুর বাড়ির কূটকৌশলের কাছে হার মেনে জীবন দিচ্ছে।
২০১০ সালে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল এর এক ডা. মেয়ের লাশ আত্মহত্যা বলে ঝুলিয়ে রেখেছিল। পরে এটা নিয়ে শোকসভা হলো। সবাই প্রকাশ্য বলছিল তার আত্মীয়স্বজনরা এটি হত্যা কেস বলে দাবি করেছিল। মেয়েটির বাবা বরিশালের কোন এক কলেজের অধ্যক্ষ। তিনিও এসেছিলেন। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। তার অপরাধ ছিল সে আরো পড়ালেখা করতে চেয়েছিল । তখন সে ওখানে ট্রেনিং নিচ্ছিলো। কিছুদিন আগে ঠিক এমন ঘটনা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া মেয়ের কপালে জুটেছিল।
সমাজের সর্বস্তরের কি সাধারণ, উচ্চবিত্ত, নাকি নিম্নবিত্ত সব ঘরের নববধূদের এমন নির্যাতনের বলিদান হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত । আমরা মিডিয়ার বদৌলতে ছিটেফোটা মাত্র জানতে পারি। যখন কেলেঙ্কারির শেষ পর্যায় যায় তার আগেই ধামা চাপা দেয়া হয়ে যায়। ২০১৫/১৬ এক সমীক্ষায় দেখে গেছে বছরে প্রায় ২০০ নারী এই যৌতুকের কারনে হত্যা হয়েছে। একই কারনে ২৫টার মত আত্মহত্যা করেছে।
যৌতুকের কারণে শুধু স্বামী একা নয়; পরিবারের সবাই শাশুড়ী, দেবর, ননদ তারা এক জোট হয়ে কেরোসিন ও দিয়াশলাই ছেলের হাতে তুলে দেয়। এগুলো আমাদের সমাজে গা সওয়া হয়ে গেছে কারণ মানবাধিকার এখানে অত্যন্ত নড়বড়ে। বিয়ের সময় বরপক্ষের চাহিদা মত সবকিছু দিয়েই বিয়ে হয় । তারপর তাদের নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয়। কারো ব্যবসার জন্য পুঁজি দরকার। তাই নববধুকে তার বাবার কাছ থেকে আনতে বলে। কিংবা বিদেশে চাকরি করতে যাবে সে তার জন্য শশুরের কাছে টাকার দাবি। মেয়েটি আনতে অস্বীকার করলে তার উপর শুরু হয় নির্যাতন।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মানসিকতা বদল না হলে নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন না হলে এটা চলতেই থাকবে। যৌতুককে মূলোৎপাটন করতে চাইলে পরিবার থেকে সচেতন হতে হবে। একই পরিবারে ছেলেমেয়েকে সমান শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তার অর্থনৈতিক মুক্তি শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। তাই সর্বস্তরে দৃষ্টি ভঙ্গির আমূল পরিবর্তন দরকার।
পরিবারের মায়েরা মেয়ে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে জেনেও বলবে মানিয়ে চলো। মানিয়ে চলতে যেয়ে কত মেয়ে প্রাণ দিচ্ছে। পরিবারের ধ্যানধারণা এ ব্যাপারেও বদলাতে হবে। নির্যাতিত মেয়েকে কাছে টেনে নিতে শিখতে হবে। বিয়ে ভাঙ্গার চেয়ে বেঁচে থাকাটা ঢের আনন্দের। সেটা বুঝতে হবে। নির্যাতিত মেয়েরা কারো বোন, কারো ভাগ্নি। আর যে পরিবারের লোকজন নির্যাতন করে তাদের মেয়েরাও তো অন্যের ঘরে এমন অত্যাচারের শিকার হতে পারে। সেটা মনে রেখে সবাই ব্যপারটা সহানুভুতির দৃষ্টিতে দেখলে তবেই সমাজ থেকে ধীরে ধীরে বিতাড়িত হতে পারে এই যৌতুকের অভিশাপ।