হজ আদায় না করার ভয়াবহ শাস্তি

হজ আদায় না করার ভয়াবহ শাস্তি

ছবি: সংগৃহীত

হজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলীর মাধ্যমে বায়তুল্লাহ শরিফ জেয়ারত করাকে হজ বলা হয়। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- وَلِلهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ করা ফরজ। (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)

হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’(বুখারি: ৭২৮৮)

যাদের ওপর হজ ফরজ, যত দ্রুত সম্ভব হজ আদায় করা উত্তম। যেখানে মানুষের জীবন-মরণের এক সেকেন্ডের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে এক বছর অনেক দীর্ঘ সময়। তাই রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা করে নেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ: ১৭৩২)

পাঁচটি শর্তসাপেক্ষে হজ ফরজ। ১. মুসলিম হওয়া ২. আকল থাকা বা বিবেকবান হওয়া অর্থাৎ পাগল না হওয়া ৩. বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ৪. আজাদ বা স্বাধীন হওয়া অর্থাৎ কারো গোলাম না হওয়া এবং ৫. দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া। মহিলাদের ক্ষেত্রে আরেকটি শর্ত যুক্ত হবে, সেটি হলো- সঙ্গে ‘মাহরাম’ (যেসব পুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত জায়েজ) থাকা।

হজ ফরজ হওয়ার সম্পর্ক মক্কায় আসা-যাওয়ার খরচের সঙ্গে। সুতরাং স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপর হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম: ২/১৫২; আহসানুল ফতোয়া: ৪/৫১৬)

একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম: ২/১৫৩)

মুসলিম সমাজে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে- আগে মাতা-পিতার হজ করাবে, পরে নিজের কথা চিন্তা করবে; এটি সঠিক নয়, বরং সামর্থ্য থাকলে তাঁদের নিয়ে একসঙ্গে হজ করবে। অন্যথায় আগে নিজের ফরজ আদায় করবে। (রহিমিয়া: ৮/২৮২)

আবার অনেকে মনে করেন, সন্তানের বিয়ে দেওয়ার পর হজ আদায় করতে হয়। অথচ এ কথা ইসলাম সমর্থিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানের বিয়ে জরুরি ঠিক আছে, তাই বলে সন্তানের বিয়ের জন্য হজে বিলম্ব করা যাবে না। (রহিমিয়া: ৮/২৭৬)

সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করার পরিণাম ভয়াবহ। ফরজ হজ ত্যাগ করলে ইহুদি-নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। রাসুল (স.) বলেন, ‘বায়তুল্লাহর হজ করার জন্য যে ব্যক্তির পথসম্বল আছে এবং বাহন ইত্যাদির ব্যয় বহনের সামর্থ্য আছে অথচ সে হজ সম্পাদন করে না, সে ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক, তাতে কিছু যায়-আসে না।’ (তিরমিজি: ৮১২; বায়হাকি: ৩৬৯২)

অন্য হাদিসে উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বাহ্যিক স্পষ্ট কোনো প্রয়োজন কিংবা অত্যাচারী বাদশাহ অথবা প্রতিবন্ধক সৃষ্টিকারী কোনো রোগের কারণে হজে গমনে বাধাগ্রস্ত হওয়া বিনে হজ না করে মৃত্যুবরণ করল, সে চাইলে ইহুদি হয়ে মরতে পারে। চাইলে খ্রিস্টান হয়ে মরতে পারে।’ (দারেমি: ১৮২৬; বায়হাকি: ৩৬৯৩)

হাদিস অনুযায়ী ফরজ হজ অবশ্যই পালন করতে হবে। তবে তিনটি কারণে হজে যেতে অপারগ হলে তা আল্লাহর কাছে মার্জনীয় হবে—১. পাথেয় অথবা পরিবহন সমস্যা; ২. অত্যাচারী রাজা-বাদশাহ বা সরকারের ক্ষতির আশঙ্কা; ৩. ব্যাধির কারণে হজযাত্রায় অপারগতা। এছাড়া কেউ হজ পালনে বিরত থাকলে তার মৃত্যুকে ইহুদি-খ্রিস্টানের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

এমনকি ফরজ হজ দ্রুত সম্পাদনের নির্দেশনা রয়েছে হাদিস শরিফে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীরকে সুস্থ রাখলাম, তার রিজিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার ঘরের হজের উদ্দেশ্যে আগমন না করে তাহলে সে হতভাগ্য, বঞ্চিত।’ (ইবনে হিব্বান: ৩৬৯৫; মুসনাদে আবু ইয়ালা: ১০৩১; তবারানি: ৪৯০)

শুধু তা-ই নয়, একসময় বায়তুল্লাহ উঠিয়ে নেওয়া হলে মানুষ হজ করতে পারবে না—এই আশঙ্কার কারণেও আল্লাহর রাসুল উম্মতকে তাড়াতাড়ি হজ করার হুকুম করেছেন। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরার মাধ্যমে এই ঘরের (বায়তুল্লাহ) উপকার গ্রহণ করো। কেননা তা এর আগে দুইবার ধ্বংস হয়েছে। তৃতীয়বারের পর উঠিয়ে নেওয়া হবে।’ (ইবনে খুজাইমা: ২৫০৬; ইবনে হিব্বান: ৬৭১৮; মুসনাদে বাজ্জার: ১০৭২; মুসতাদরাকে হাকিম: ১৬৫২)

হজ করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থবিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ করে না, তার সম্পর্কে হাদিস শরিফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘আমার ইচ্ছা হয় কিছু লোককে বিভিন্ন শহরাঞ্চল ও লোকালয়ে পাঠিয়ে দিই, তারা সেখানে দেখবে কারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ করছে না। তারা তাদের ওপর কর আরোপ করবে। তারা মুসলমান নয়।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৫৭৮)

হজ-ওমরা না করে সন্ন্যাসী হওয়ার চেষ্টাও ইসলাম অনুমোদন করে না। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, ইসলামে বৈরাগ্য নেই। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হজের ক্ষেত্রে কোনো বৈরাগ্য নেই। (মুসনাদে আহমদ: ৩১১৩; আবু দাউদ: ১৭২৯)

ওপরে উল্লেখিত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে সামর্থ্য থাকার পরও যেসব মুসলমান হজ করে না, কেয়ামতের দিন তারা কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হবে। সেদিন শত অবকাশ চাইলেও তাদের আর হজ পালনের সুযোগ দেওয়া হবে না। ফলে তারা নিদারুণ শাস্তি ভোগ করবে।

মোদ্দাকথা, হজ পালনের ব্যাপারে সামান্য উদাসীনতা সীমাহীন শাস্তি ও আজাবের কারণ হতে পারে। হজ ত্যাগকারীর বিরুদ্ধে রাসুল (স.) যেখানে ‘বিধর্মী হয়ে মৃত্যুবরণ’ করার মতো চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, সেখানে কোনো ঈমানদার ফরজ হজের ব্যাপারে কালবিলম্ব করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উপযুক্ত সময়ে হজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।