রাজনৈতিক চাপে জেমসের কনসার্ট বন্ধ, দাবি আয়োজকদের

রাজনৈতিক চাপে জেমসের কনসার্ট বন্ধ, দাবি আয়োজকদের

ছবি: সংগৃহীত

প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় মেহেরপুরের ‘সূর্য ক্লাব’ উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত জেমসের কনসার্ট স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টি ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নিশ্চিত করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে জানায়, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে কনসার্টের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।  

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জেমসের ব্যক্তিগত সহকারী রবিন ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, প্রশাসন কেন অনুমতি দেয়নি সেটা আমরা জানি না। এ ব্যাপারে আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। 

এবার যোগাযোগ করা হয় কনসার্টের আয়োজক ‘সূর্য ক্লাব’-এর সভাপতি নাহিদ মাহবুব সানী এবং সাধারণ সম্পাদক নাসিম রানা বাঁধনের সঙ্গে। তারা জানান রাজনৈতিক চাপে জেমসের কনসার্টের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। তাদের দাবি, মেহেরপুর জেলা বিএনপির একটি অংশ, মেহেরপুর এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর আপত্তি থাকায় জেমসের কনসার্ট সম্মতি দিচ্ছে না প্রশাসন। 

‘সূর্য ক্লাব’ -এর সাধারণ সম্পাদক নাসিম রানা বাঁধন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘‘আমরা জেমসের কনসার্টের অনুমতি চেয়ে লিখিত আবেদনের পর মেহেরপুর ডিসি মহোদয়ের কাছে যাই। তিনি আমাদের বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। মেহেরপুর সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। আপনাদের অনুষ্ঠানটি যদি পুলিশ প্রশাসন থ্রেট  মনে না করে তাহলে কোনো আপত্তি নেই।’ তার থেকে আশ্বাস পাওয়ার পর আমরা মেহেরপুরের ওসি, এসপি,  সার্কেল এসপি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করি। তারাও আমাদের আশ্বস্ত করেন। এস পি মহোদয় বলেন, ‘এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। তোমরা এগিয়ে যাও। আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব।’ সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু প্রচারণা চলাকালীন একদিন ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় আমাদের প্রচার মাইকের অটোচালককে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হন। লোকটা হাত-পা ধরে বেঁচে ফেরে। এ ঘটনা শোনার পর আমরাও প্রচারকার্য স্থগিত করি। এদিকে আমরা দরখাস্ত জমা দিয়েছিলাম ১০ তারিখ। ১৫ দিন কেটে গেলেও প্রশাসন থেকে হা বা না কিছু জানাচ্ছিল না।’’ 

মেহেরপুর জেলা স্টেডিয়ামকে জেমসের কনসার্টের ভেন্যু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। বাঁধন জানান ভেন্যুকে কেন্দ্র করেই কনসার্টের বিরোধিতা শুরু। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভেন্যু ছিল মেহেরপুর জেলা স্টেডিয়াম। কিন্তু দেখলাম কয়েকজন খেলোয়াড়কে উসকে দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ করানো হচ্ছে। তারা স্টেডিয়ামে কনসার্টের ভেন্যুর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। আমরা ঝামেলায় জড়াতে চাই না বলে বিকল্প ভেন্যু হিসেবে ভেবে রাখি।’ 

সাধারণ সম্পাদের দাবি, খেলোয়াড়দের উসকানোর পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন মেহেরপুর এনসিপির কয়েকজনব নেতৃবৃন্দ। তার কথায়, ‘আমাদের জেলা ক্রীড়া কমিটির অ্যাডহক কমিটিতে এনসিপির কয়েকজন নেতৃবৃন্দ আছেন। তারা কনসার্টের ব্যাপারে সরাসরি ডিসির কাছে গিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।’

বাঁধন জানান এনসিপির ওই নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে মেহেরপুরের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণের ভাই আইনজীবী ও বিএনপি নেতা মারুফ আহমেদ বিজনের। তাকে কনসার্টে প্রধান অতিথি করা হয়নি বলেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। 

‘সূর্য ক্লাব’ -এর সাধারণ সম্পাদকের কথায়, ‘বিজন সাহেব আকার ইঙ্গিতে বোঝাতেন তাকে অতিথি করা হলে কনসার্টে বাধা আসবে না। এর আগে আমরা দুটি কনসার্ট করেছি। সে সময় লক্ষ্য করেছি তাকে অতিথি করা হলে বাধার সৃষ্টি হয় না। সে কারণে তাকে অতিথি করেই প্রোগ্রামগুলো সামলেছি। কিন্তু জেমসের প্রোগ্রামটি অনেক বড়। আমরাও একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। চাইছিলাম না কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে প্রধান অতিথি করতে। আমরা ডিসি মহোদয়কে প্রধান অতিথি বানিয়ে অনুষ্ঠানটি করতে চাইছিলাম। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ভিআইপি কার্ড রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অতিথি না করাতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।‘  

এবার প্রশাসনের আচরণ তুলে ধরে বাঁধন বলেন, ‘‘২৫ সেপ্টেম্বরের পর আমরা এসপি মহোদয়ের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘এখনকার বাতাসটা একটু অন্যরকম। আমি যেহেতু এখানে নতুন তাই বুঝতে পারছি না। তোমরা একটু ম্যানেজ করো। আমরা কাকে ম্যানেজ করব জানতে চাইলে তিনি আবার বলেন যে তোমরা ম্যানেজ করো।’ পরে আমরা ডিসি স্যারের কাছে যাই। তাকে না পেয়ে এডিসি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি তোমাদের মুরুব্বিদের খুশি করতে পারোনি?’ ৫ আগস্টের পরও যে আবার কাউকে খুশি করতে হবে এরকম ধারণা ছিল না আমাদের। কোন মুরুব্বিদের খুশি করতে হবে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। বলেন, ‘ব্যাপারটি আমার হাতে নেই। এটি ডিসি স্যার ও  এসপি মহোদয়ের ওপর নির্ভর করছে।’’ 

কনসার্টে  বাঁধায় এনসিপির জড়িত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বাঁধন বলেন, ‘মেহেরপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে কমিটি ছিল আমি সেই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম। আহ্বায়ক ছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ। কনসার্ট বিষয়ক শেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। উনিও চেয়েছিলেন প্রোগ্রামটি হোক। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের পর তিনি আমাকে ফোন দিয়ে জানান, তাকে শাকিল (শাকিল আহমেদ) ভাই ও সোহেল (সোহেল রানা) ভাই ফোন দিয়েছিলেন। ওনারা মেহেরপুর জেলা এনসিপির প্রধান। তারা দুজনেই এনসিপি থেকে মেহেরপুর ১ ও ২ আসনের এমপি পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী। ইমতিয়াজ ভাই আমাকে বলেন, ‘মেহেরপুর এনসিপির জেলা সমন্বয়কারী শাকিল আহমেদ ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন, আমি কেন ওখানে গেছি। মেহেরপুর জামায়াতের লোকজন শাকিল ভাইকে ফোন দিয়ে বলেছে, তোমরা বলেছ কনসার্টের সঙ্গে তোমরা নেই অথচ ইমতিয়াজকে সংবাদ সম্মেলনে পাঠাচ্ছ। তোমরা আড়ালে ওদের সাথে আছ।’ এরপর শাকিল ভাই ইমতিয়াজ ভাইকে বলেন ফেসবুকে বিবৃতি দিয়ে জানাতে যে এই কনসার্টে পক্ষে কিংবা বিপক্ষে আমরা নেই।’’

কনসার্ট বন্ধে বিজনের সঙ্গে এনসিপি ও জামায়াতের যোগসাজশের কারণ জানতে চাইলে এ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মেহেরপুর জেলা বিএনপির দুটি গ্রুপ আছে। বিজনদের গ্রুপের স্বার্থের বাইরে কিছু গেলে তারা এনসিপির লোকজন নিয়ে দলে ভারি করে কাজটি হাসিল করেন। কনসার্ট বন্ধের ক্ষেত্রেও তারা একই কারণে এক হয়েছেন। আর জামায়াত গান বাজনা পছন্দ করে না। ফেসবুকে কমেন্ট থেকে শুরু করে সব জায়গায় গান-বাজনার বিরোধিতা করে। তারা বলছে গান-বাজনার বদলে ওয়াজ মাহফিল করতে। এ কারণে হয়তো তারা বিরোধিতা করছে।’ 

জামায়াত গান বাজনা পছন্দ করে না। ফেসবুকে কমেন্ট থেকে শুরু করে সব জায়গায় গান-বাজনার বিরোধিতা করে। তারা বলছে গান-বাজনার বদলে ওয়াজ মাহফিল করতে। এ কারণে হয়তো তারা বিরোধিতা করছে।

একইসঙ্গে কনসার্ট বন্ধের পেছনে আইনজীবী ও সাংবাদিক তুহিন অরণ্যকেও দায়ী করেন বাঁধন। তার কথায়, ‘মেহেরপুরে তুহিন অরণ্য নামে এক সাংবাদিক আছেন। তিনি আইনজীবীও। তার নামে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলাও আছে। আসামি থাকাকালীন তাকে মেহেরপুর জজ কোর্টে মহিলা ও শিশু বিষয়ক পিপি নিয়োগ দেওয়া হলে সাধারণ মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আমি তখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিতে ছিলাম। নৈতিকতার জায়গা থেকে মনে হয়েছিল প্রতিবাদ করি। আমরা জেলা জজ কোর্ট ঘেরাও করে আন্দোলন করেছিলাম। এতে করে ওই দিন-ই তাকে পিপি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই জায়গা থেকে আমাদের ওপর তার একটা রাগ আছে। এজন্য তিনিও ওপর মহল থেকে চাপ প্রয়োগ করিয়েছেন কনসার্ট বন্ধে।’

সবশেষে বাঁধন বলেন, ‘কনসার্ট নিয়ে শেষবার সংবাদ সম্মেলনের পরের দিন প্রশাসন থেকে আমাদের জানানো হয়, গোয়েন্দা সংস্থার অনাপত্তি পত্র না পাওয়ায় এবং স্টেডিয়ামের অ্যাডহক কমিটির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ ধরনের আয়োজনে তারা অনুমতি প্রদান করবে না।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মারুফ আহমেদ বিজন বলেন, ‘গত পরশু ওদের দুই-তিন জন ছেলে আমার চেম্বারে এসেছিল। ওইদিনই জানলাম মেহেরপুরে জেমস আসছেন। তারা আমাকে বিষয়টি জানিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করে। আমি বলেছি, প্রশাসন আমাকে পছন্দ করে না। সে কারণে আমি এসব ব্যাপারে প্রশাসনকে বলতে পারব না। কেননা এর আগে বেশ কয়েকটি ব্যাপারে প্রশাসনকে অনুরোধ করলে শোনেনি। তাছাড়া আমি নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি। সেখানে জেমস এলো না কে এলো সেসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’

আমি বলেছি, প্রশাসন আমাকে পছন্দ করে না। সে কারণে আমি এসব ব্যাপারে প্রশাসনকে বলতে পারব না। কেননা এর আগে বেশ কয়েকটি ব্যাপারে প্রশাসনকে অনুরোধ করলে শোনেনি। তাছাড়া আমি নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি। সেখানে জেমস এলো না কে এলো সেসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

অভিযোগ স্বীকার করেননি মেহেরপুর এনসিপির জেলা সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট শাকিল আহমেদও। তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন খবর। এখানে আমাদের জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। জেমস এখানে আসবে্ন কি আসবেন না তার সিদ্ধান্ত নেবে আয়োজক ও প্রশাসন। আমরা সব সময় চাই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসার ঘটক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন যদি মনে করে কেউ এলে ভালো হবে না সেটা তাদের ব্যাপার। এখানে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এ নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনাও নেই। তাছাড়া আমি আয়োজকদের কাউকে চিনি না। তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়ও নেই।’

তুহিন অরণ্যও অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘গত দুইদিন আমার কাছে কয়েকজন এসেছিল। তার আগে আমি অনুষ্ঠানটির কথা জানতাম না। ওরা এসে আমাকে বলল প্রোগ্রাম হচ্ছে না। আমি তখন বলেছি, ‘জেমস এর প্রোগ্রাম অনেক বড় ব্যাপার। এ নিয়ে কি তোমরা আগে স্টাডি করেছ? ওরা বলল, প্রাথমিকভাবে আলোচনা করেছিলাম তখন প্রশাসন থেকে সবুজ সংকেত দিয়েছিল। এখন আপত্তি করছে। আমি তখন বললাম আমি কোনো পদে নেই এবং আমি প্রশাসনেরও কেউ না। আমি তো এ ব্যাপারে বলতে পারি না।’ তখন ওরা-ই বলে, ‘তাহলে আপাতত ছোট করে একটি অনুষ্ঠান করি। জেমসকে নিয়ে তাহলে পরে করব।’’  

এরপর তুহিন অরণ্য বলেন, ‘সে সময় তো তারা আমাকে এসব অভিযোগ দেয়নি যে আমি বাধা দিচ্ছি কিংবা এরকম কিছু। বিগত সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রী ছিলেন আমাদের মেহেরপুরের। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আসামি তালিকায় (পর্নোগ্রাফি মামলায়) আমার নাম দিয়েছিলেন। আমি মামলার আসামি না চার্জশিটের আসামি ছিলাম। এটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছিল করেছিল। এ নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। তারা যদি মনে করে ওই রাগ পুষে রেখে কনসার্টে বাধা প্রদান করেছি তাহলে ভুল।’