ঋণ পরিশোধে শিথিলতা বাড়তে পারে

ঋণ পরিশোধে শিথিলতা বাড়তে পারে

ঋণ পরিশোধে শিথিলতা বাড়তে পারে

মারাত্মক আকার ধারণ করছে করোনা পরিস্থিতি। কভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ পেরিয়ে তৃতীয় প্রবাহেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংকঋণ পরিশোধে চলমান শৈথিল্য আরো ছয় মাস বাড়ানোর কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে এ নিয়ে দাবি আসছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধে শিথিলতার সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়াতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে শিগগিরই এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে।

দেশের চলমান করোনা পরিস্থিতি করপোরেট জগতে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। আমদানি রফতানির পাশাপাশি আবারো স্থবির হতে চলেছে দেশের অভ্যন্তরীণ খাত বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলছে আবারো অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের প্রায় সব সংগঠনই ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে শৈথিল্যের দাবি তুলতে শুরু করেছে।

২০২০ সালজুড়ে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত ছিলেন ব্যবসায়ীরা ফলে কোনো অর্থ পরিশোধ না করেই ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে শর্ত সাপেক্ষে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয় ৩০ জুন পর্যন্ত সে হিসেবে চলতি মাসের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ গ্রাহকদের খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা।

গত বছরের মতো এবারো ঋণ শ্রেণীকরণ না করার দাবি তুলেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ থেকে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছেব্যবসায়ীদের দাবি ও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ঋণ শ্রেণীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নীতি ছাড়ের মেয়াদ বাড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে দেয়া নীতি ছাড়ের মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। রফতানি বিল প্রত্যাবাসন ও ঋণপত্রের দায় সমন্বয়ের সময় বৃদ্ধি, রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ ও মেয়াদ বৃদ্ধির মতো নীতিসহায়তার বিষয়গুলো এ ছাড়ের আওতায় রয়েছে। 

মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত সব খাতেই লেগেছে বলে মনে করছেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন তিনি বলেন, করোনার প্রথম আঘাত ছিল নগরকেন্দ্রিক। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে তা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে।আগের মতোই আমাদের আমদানি রফতানি খাতের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারও ক্ষতির মুখে পড়েছে এ অবস্থায় সব খাতের ব্যবসায়ীরাই চাইছেন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ স্থগিত করা হোকদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে সবাই এফবিসিসিআইয়ের কাছে দাবি জানাচ্ছে এজন্যই আমরা এফবিসিসিআই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে চিঠি দিয়েছি আশা করছি, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকগুলোও বিপদে পড়বে।

তবে ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে এ মুহূর্তে গণহারে সব ঋণে ছাড় দেয়ার বিপক্ষে ব্যাংকাররা তারা বলছেন, ঋণ পরিশোধ বন্ধ হয়ে যায় এমন কোনো নির্দেশনা দেয়া ঠিক হবে না বরং চলতি, তলবি ও মেয়াদি ঋণ পরিশোধের জন্য যে সময়সীমা দেয়া হয়েছে, সেটি বাড়ানো যেতে পারে।

দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন এ প্রসঙ্গে বলেন, বিরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও বেশির ভাগ গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছেন ব্যাংকারগ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অনেক গ্রাহককে আমরা ছাড়ও দিচ্ছি বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের মতো করে গণ ছাড় দেয়া ঠিক হবে না আমরা চাই না, ঋণ পরিশোধ একেবারে বন্ধ হয়ে যাক ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করাটা গ্রাহকের অভ্যাসে পরিণত করা ঠিক হবে না গণছাড় না দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঋণ পরিশোধে যে সময়সীমা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঠিক করে দেয়া হয়েছে, সেটির মেয়াদ ও কিস্তি সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।

চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সব ঋণের শ্রেণীকরণ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে গত ১৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে চিঠি দেয় এফবিসিসিআই চিঠিতে করোনাসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ও গৃহীত পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করা হয় পাশাপাশি ব্যবসাবাণিজ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতি তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব বিদ্যমানঅধিকাংশ শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধাগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি করা না হলে অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনিচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকে পরিণত হবে, যা ব্যাংক খাতসহ পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে এফবিসিসিআই।

এফবিসিসিআইয়ের মতোই চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ শ্রেণীকরণ স্থগিত চেয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান ও বিকেএমইএর সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে পোশাক খাতের সংকট ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয় এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ঋণের কিস্তি পরিশোধে নীতিসহায়তার মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়ে যাবেএজন্য নীতিসহায়তার মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়িয়ে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণ খেলাপি না করার অনুরোধ করেছে সংগঠনটিপাশাপাশি কোনো ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে সেটিও পুনঃতফসিল করে দেয়ার সুযোগ প্রদানের অনুরোধ করা হয়।

ঋণ পরিশোধে শিথিলতার বিষয়টি আলাপ আলোচনার মধ্যে আছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবিদাওয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এক্ষেত্রে একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত হবে নাব্যবসায়ীদের দাবি যেমন শুনতে হবে, একইভাবে ব্যাংকের দিকটিও দেখতে হবেকরোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষতির মাত্রা পর্যালোচনা করা হচ্ছে সার্বিক পর্যালোচনায় যদি ঋণ পরিশোধের শিথিলতা অবশ্যম্ভাবী হয়, তবে তা অবশ্যই বিবেচনা করা হবে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় এরপর ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন অঘোষিত লকডাউন হিসেবে সাধারণ ছুটি কার্যকর করে সরকার ওই সময় দেশের শিল্প উৎপাদন থেকে বিপণন, সবকিছুতেই স্থবিরতা নেমে আসে প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাংকঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের নির্দেশনায় ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঘোষিত এ ডেফারেল সুবিধা বা পেমেন্ট হলিডে কার্যকর ছিল পুরো ২০২০ সালজুড়ে তবে নীতি ছাড়ের এ সুযোগ বেশির ভাগ ঋণগ্রহীতাই নেয়নিবাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই সময় ডেফারেল সুবিধার আওতায় এসেছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অর্থাৎ দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের ২৩ শতাংশ ওই সময় ডেফারেল সুবিধা নিয়েছিল।