ঘুম-চুরির দেশ

ঘুম-চুরির দেশ

ছবি: সংগৃহীত

তন্দ্রালু চোখ। স্বপ্নের ঘোর। হিমেল স্পর্শে শীত কাটাতে হাতড়ে খুঁজি কাঁথাফোঁড়ের চাদরখানি। এমন আমেজভরা ঘুমের আদর কখনও কেউ চুরি করতে পারে কি? অবাক হবেন না। এমনটা হতেই পারে, মাইপোখারিতে এলে। পূর্ব নেপালের ইলাম শহর থেকে উত্তরে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে শান্ত, নিরিবিলি পাহাড়ি এক গ্রাম।

যখন পৌঁছলাম, তখন হাতঘড়ির সময় বলছে সন্ধে ছ’টা। এখানে তখন গভীর রাত। বাতাসে কনকনে ঠান্ডা। জামা ভেদ করে শীত দাঁত বসাচ্ছে শরীরে। পথের ক্লান্তিতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হোমস্টের লেপকম্বলের তলায় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। আবছা কুয়াশাজড়ানো প্রকৃতি তখন আড়মোড়া ভাঙছে। ধোঁয়াটে পাহাড় হাই তুলছে। স্বপ্নালু আকাশ তার নীল রং খুঁজছে।

প্রায় আপাদমস্তক গরম পোশাক পরে বেরিয়ে পড়লাম কয়েকজন। দূর থেকে একে অপরকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন ছায়ামূর্তি। কাঁচা পথের দু’পাশে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুগুলি জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। পাশের খামারগুলোয় নিঃসঙ্গ চমরি গাই জাবর কাটছে। গলায় ঝোলানো লালরঙা ঘণ্টায় টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। কিছুটা হাঁটার পরে থমকে দাঁড়ালাম। সামনের সবুজ ঘাসের মাঠ যেন সাদা বরফের চাদরে গা ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সারা রাত ধরে এখানে শিশির ঝরেছে। পুব দিকে পাহাড়গুলি খানিকটা উচ্চতা পর্যন্ত গভীর অরণ্যের পোশাকে নিজেদের ঢেকে রেখেছে। ট্রিলাইন শেষ হতেই তাদের চুড়োগুলো যেন বেআব্রু ঔদ্ধত্যে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। পাহাড়ের আড়াল থেকে সূর্যদেব ক্রমাগত উঁকি মারছেন।

মাইপোখারিতে বসবাস করেন হাতে গোনা কয়েকশো মানুষ। গ্রামের ঠিক শুরুতে ছোট্ট বাজার। বাকি কয়েকটি বাড়িতে হোমস্টে। পাথর, কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়িঘর। প্রতিটি বাড়িতে উড়ছে লাল-সাদা-নীল পতাকা। গ্রামের বাঁকে বাঁকে উপভোগ করা যায় হিমালয়ের রূপ। পাহাড়ের কোলে মেঘ-কুয়াশার দেশ। হাতের নাগালে মেঘ, চাইলেই যেন ছোঁয়া যায়। রাত হলেই পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট জনপদে জ্বলে ওঠে আলো। অবশ্য সন্ধে সাতটার পরে সে সব নিভে যায়।

মিনিট কুড়ি হাঁটার পরে একটা তোরণের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তোরণের দু’পাশে কুলুঙ্গি। সেখানে প্রদীপ জ্বলছে। মাইপোখারি লেকের প্রবেশপথ। পাশে কাউন্টার। নগদ একশো নেপালি রুপি দিয়ে ঢুকে পড়লাম। খানিকটা এগোনোর পরেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কাঁচা পথ। চারদিক নিস্তব্ধ, গা ছমছমে। বড় বড় গাছের পাতা ঢাকা আলো-আঁধারি ভিজে স্যাঁতসেঁতে পথ। দু’ধারে বিছিয়ে রংবাহারি পাহাড়ি ফুল। গাছের গায়ে চুলের গোছার মতো কিছু ঝুলছে। সামনে গিয়ে দেখি এক ধরনের ফার্ন। পুরনো গাছের গায়ে লেপ্টে রয়েছে অর্কিড, মস। ঝাউ, পাইনের মাঝখান দিয়ে অনন্ত সবুজ পথ। এই পথ শেষ না হলে কিছু যায় আসে না। এ পথে ক্লান্তি নেই। ক্লান্তির উপরে ঝরে পড়ে আছে নাম না জানা বুনো ফুল...

জঙ্গলের রোম্যান্টিক শুঁড়িপথ ধরে পাহাড়ি নিসর্গকে দু’চোখে রেখে দিকশূন্যপুরের দিকে যেতে যেতেই হঠাৎ থমকাতে হয় পাশের অপূর্ব লেক দেখে। গাঢ় নীলরঙা তার জল। সেই লেক দেখে মন যেমন বিমোহিত হয়, তেমনই সৌন্দর্যসুধা পান করে তৃপ্তির আধারও ভরে কানায় কানায়।

মাইপোখারি লেক নেপালের ইলাম জেলার অন্যতম পবিত্র লেক। হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়েরই তীর্থস্থান। প্রায় ১ কিলোমিটার দীর্ঘ। লেকের মধ্যে ফুটে উঠেছে এক আশ্চর্য জলছবি! লেকের ঘন নীল জল। সাদা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে ভরা আকাশ। দূরের জঙ্গলে ঘনিয়ে আসে কুয়াশা। দৈত্যাকার গাছ মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ঘোরের সৃষ্টি করল। নীল-সবুজের মায়াবী হাতছানিতে প্রকৃতিপ্রেমীদের বুঝি ডাকছে অহর্নিশ।

যাঁদের ট্রেকিংয়ের প্রতি ঝোঁক আছে, অথচ মনে ইচ্ছে থাকলেও শরীর সঙ্গ দেয় না, তাঁরাও অনায়াসেই চারপাশটা ঘুরে ফেলতে পারেন। লেকের আশপাশটা রক গার্ডেনের মতো সাজানো। একটি অর্কিড হাউসও দেখলাম। নেপালের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা গাছ রাখা আছে। আধো ছায়াঘেরা পথ ধরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হলে একটু বসতে পারেন লেকের ধারে, গাছের ছায়ায়। এটাই হিমালয়। সেখানে শুধু রোমাঞ্চ উত্তেজনা নয়, শান্ত স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে মন ভরে যায়।
লেকের চারদিকে চারটি ঘাট আছে। সেগুলিতে ধূপ জ্বলছে। কোন ফাঁকে যেন ভক্তরা এসে পোখারির জল ছুঁয়ে পুজো দিয়ে গিয়েছেন। একপাশে আছে একটি মন্দির। কয়েকটা পাখি তার চাতালে বসে কী যেন আলোচনা করছে... শান্ত নিরিবিলি এই স্থান মিটিংয়ের উপযোগী বটে!

দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হলে সাদা চাদরের তলায় ঢাকা পড়ে যায় মাইপোখারি। হোমস্টের ঝুল বারান্দায় বসে সূর্যাস্তর লালিমা মনের গ্লানি ভুলিয়ে দেয়। গোধূলিতে গ্রামে একটি দু’টি করে আলো জ্বলে ওঠে। পাহাড়ের বুক চিরে তারারা জেগে ওঠে। চিন্তার জালগুলো ছিন্ন হয়ে ডানা মেলে স্বপ্নের জগতে। ভোর হলে আকাশের লালিমা পর্দার ফাঁক গলে ঘুম চুরি করে নিয়ে যায়, অনুমতির তোয়াক্কা না করেই।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা