কুরবানির ইতিহাস ও শিক্ষা

কুরবানির ইতিহাস ও শিক্ষা

রায়হান সিদ্দিক ফয়সাল

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কুরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদেও জীবন উপকরণ স্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে”---(সুরা হজ; আয়াত: ৩৪)

ভূমিকাঃ কুরবানি শব্দের শাব্দিক অর্থ সৎ কাজ করা, সন্নিকটে আসা, উৎসর্গ করা ইত্যাদি। যে বস্তু ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় তাকে কুরবানি বলে। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব জাতিই কোন না কোন পদ্ধতিতে মহান আল্লাহর দরবারে নিজেেেদর প্রিয় বস্তুকে কুরবানি করেছেন। তাই সামর্থ্যবান মুসলমানদের উপর কুরবানি ওয়াজিব করেছেন। তবে কুরবানির ক্ষেত্রে পশু কুরবানির প্রতি যেমন গুরুত্ব দিতে হয় তেমনি কুরবানির শিক্ষার প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে।

কুরবানির ইতিহাসঃ মানব ইতিহাসে প্রথম কুরবানিদাতা হলেন আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এর পুত্র হাবিল ও কাবিল (রঃ)। দুনিয়ার প্রাথমিক অবস্থায় আদম ও হাওয়া (আঃ) এর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে এক সাথে জন্মগ্রহণ করত: পরবর্তী গর্ভে অনুরূপ একটি ছেলে একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করতো। তখন পূর্ব গর্ভের ছেলে মেয়ের সাথে পরবর্তী গর্ভের ছেলে মেয়ের বিবাহ দেয় হত। হাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিলনা কিন্তু কাবীলের যজম বোন সুন্দরী ছিল। তৎকালীন শরীয়ত অনুপাতে হাবিলের বিবাহ কাবীলের যমজ বোনের সাথে। আর কাবীলের বিবাহ হাবীলের যমজ বোনের সাথে হবার কথা কিন্তু কাবীল তা মানতে অস্বীকৃতি জানাল। হযরত আদম (আঃ) বোঝানোর পরও তা সে বুঝল না। পরবর্তীতে আদম (আঃ) উভয়কে আল্লাহর নামে কুরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বললেন “যার কুরবানি কবুল হবে তার সাথে কাবীলের যজম বোনের বিয়ে দেওয়া হবে।”

প্রথম কুরবানির ঘটনাঃ হাবীল ছিল মেষওয়ালা, ফলে হাবীল একটি মোটা তাজা মেষ কুরবানির জন্য পেশ করল। আর কাবীল ছিল কৃষক, সে কিছু গমের শিষ কুরবানির জন্য পেশ করল। আসমান থেকে আগুন এসে হাবীলের কুরবানি জ্বালিয়ে দিল যা কবুল হবার নিদর্শণ। কাবীলের কুরবানি গ্রহণ করা হল না। ফলে হিসংসায় সে হাবীলকে হত্যা করার মনস্থ করল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বললেন, “আদম (আঃ)-এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ই কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হল। আর অন্য জনের কবুল হলো না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কুরবানি কবুল করেন (সূরা মায়িদা, আয়াত:২০)।”এতে প্রতীয়মান হয়, কুরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া, অর্থাৎ খোদাভীতির প্রয়োজন। লোকদেখানো ইবাদত আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন না।

কুরবানি নিয়ে হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর ঘটনাঃ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল এর ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বারা আল্লাহতায়ালা পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে কুরবানির দাওয়াত পৌঁছে দিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কুরবানির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- অতঃপর সে পুত্র (ইসমাঈল আঃ) যখন পিতা ইব্রাহিম (আঃ) সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন সে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করেছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী? পূত্র বলল, “ আব্বাজী! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ্ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন।” সুতরাং যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন, আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম; হে ইব্রাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্য পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সৎকর্মীদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিলো এক স্পষ্ট পরীক্ষা এবং আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে সে শিশুকে মুক্ত করলাম।

কুরবানির উদ্দেশ্যঃ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সম্পদ দান করেছেন এবং মানুষকে সম্পদ ব্যয় করার জন্য বিশেষ কিছু খাতও বলে দিয়েছেন। যেখানে নিসাবের মালিকদের জন্য ব্যয় করা আবশ্যক করেছেন। যেমন: যাকাত, সদকাতুল ফিতর, কুরবানি ইত্যাদি। যেহেতু সম্পদ মূলত আল্লাহরই দান বা অনুগ্রহ। তাই তিনি কোন বিধান আরোপ করলে হাসিমুখে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে উক্ত ইবাদত পালন করা আমাদের দায়িত্ব। আর কুরবানি এমন একটি ইবাদত তার সকল কায়েদাই বান্দা ভোগ করে আল্লাতায়ালা শুধুমাত্র বান্দার তাকওয়া দেখেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেনঃ “আল্লাহর কাছে ওগুলোর না গোসত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদের তুমি সুসংবাদ দাও।

কুরবানি ত্যাগ ও উৎসর্গ শিক্ষা দেয়ঃ কুরবানি করার মাধ্যমে বান্দা ত্যাগ ও উৎসর্গ করার শিক্ষা পায়। আমাদের উপর ইসলামের যে বিধানই আবশ্যক হোক, আমাদের পালন করতে হবে। আল্লাহর রাজি-খুশির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে। ইসমাঈল (আঃ) ইব্রাহিম (আঃ) এর অত্যন্ত প্রিয় সন্তান ছিলেন। প্রথমে সন্তান হচ্ছিল না, ইব্রাহিম (আঃ) দোয়া করে যাচ্ছিলেন। এরপর আল্লাহ নেক সন্তান হিসেবে ইসমাঈল (আঃ) কে দিলেন। পিতার উদ্দেশ্য সফলের জন্য উত্তম উত্তরাধিকারী। তবুও যখন আল্লাহ বললেন তোমার প্রিয় সন্তানকে জবেহ করো। ইব্রাহিম (আঃ) আদেশ পালনে কোন অলসতা করলেন না। আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সুতরাং আমাদেরও ইসলামের বিধান মানতে যত কষ্টই হোক, সহ্য করতে হবে। ইসলামের জন্যও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যথাসম্ভব ত্যাগ স্বীকারের চেষ্টা করতে হবে।

নিজের ভিতরের পশুত্বকে কুরবানি করার শিক্ষাঃ কুরবানি করার মাধ্যমে বান্দা নিজের ভিতরের পশুত্বকে কুরবানি করার শিক্ষা অর্জন করতে হবে কারন তা না হলে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব নয়। আর কুরবানির মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করা।

কুরবানি পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের শিক্ষা দেয়ঃ কুরবানি আমাদের পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের শিক্ষা দেয়। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহীদী আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে ইখলাস, কাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিপূর্ণ আত্মসমপর্ণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে।

কুরবানি ধৈর্য ধারণে শিক্ষা দেয়ঃকুরবানি আমাদের ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দেয়। আমরা যদি ত্যাগ স্বীকার করতে চাই নিয়ত শুদ্ধ করতে চাই বা আমাদের অধীনস্তের উপর খোদায়ী বিধান প্রয়োগ করতে চাই, তাহলে আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। নাফছানি কাহেশাত, শয়তানে, মালউন, দুষ্টমানুষ, কঠিন পরিবশে ও প্রতিবেশী। সবই আমাদের সামনে বাধার সৃষ্টি করে। এসব বাঁধার সামনে অঁটল থাকতে আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে, প্রিয় সন্তানকে জবাই করার মত ত্যাগ স্বীকার করতে এবং সন্তানকে আল্লাহর আদেশ মানাতে রাজি করাতে ইব্রাহিম (আঃ) এরও ধৈর্য ধারণ করতে হয়েছে। ইব্রাহিম (আঃ) সত্যি সত্যি জবাই করতে উদ্যত না হয়ে, অভিনয় করতে পারতেন। কিন্তু নিয়তে অটুট থাকার কারনে সত্যি সত্যি জবাই করতে উদ্যত হন। এটি তাঁর ধৈর্য ধারণেরই ফল।

নিজের অধীনস্তদের আল্লাহর বিধান মানতে বলার শিক্ষাঃ কুরবানি আমাদের শিক্ষা দেয়, শুধু নিজে আল্লাহর বিধান মানলে চলবেনা। নিজের অধীনস্তদের আল্লাহর বিধান মানতে বলতে হবে। তাদের মানতে বাধ্য করতে হবে, অন্যথায় ধার পাকড় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। নবীজি বলেছেন, “তোমরা প্রত্যেকে তার অধীনস্ত বিষয়ে বিজ্ঞাসিত হবে।” ইব্রাহিম (আঃ) তার ছেলেকে জবাই করতে আদিষ্ট হয়েছিলেন। আদেশটা ছিল তার ছেলে সম্পর্কে যদি ইসলাম শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে জবাই করার মত বিষয় নবী হযে ইব্রাহিম (আঃ) আদেশ পালন করতে না। অথচ বিনা সংশয়ে তিনি পালন করেছেন। এর থেকে বুঝা যায়, ব্যক্তির ক্ষেত্রে তো বটেই, পাবিরবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের ইসলামি বিধান ও পালন করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের লোকদের আল্লাহর বিধান মানতে দাওয়াত দিতে হবে, চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

সাম্য, সামাজিকতা ও আলাপ আলোচনা শিক্ষাঃ কুরবানি আমাদের সাম্য, সামাজিকতা ও আলাপ আলোচনা করতে শিক্ষা দেয়। আসলে ইসলাম ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলাম সাম্য, সামাজিকতা ও আলাপ আলোচনার গুরুত্ব দেয়। কেননা এই সুযোগ না দিলে পরিণামে ব্যক্তিতন্ত্র কায়েম হয়, ইব্রাহিম (আঃ) ইসমাঈল (আঃ) কে জবেই করার বিষয়ে দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি নবী আদেশ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তবুও প্রয়োগের আগে তিনি ছেলের অনুমতি নিয়েছেন, “বাবা আমি তো স্বপ্নে দেখেছি, আল্লাহ আদেশ করেছেনে, যাতে তোমাকে জবাই করি, তুমি কী বল?” এটি দায়িত্বশীল অধীনস্তদের সাথে সম্পর্ক অনুমিত ও পরামর্শ।

কুরবানি কাওয়া শিক্ষা দেয়ঃ কুরবানি আমাদের সহীহ নিয়ত তাকওয়া শিক্ষা দেয়। নিয়তের গুনেই কাজ ভালো বা খারাপ হয়। আমরা অনেক টাকা পয়সা দান করলেও দনিয়াবী উদ্দেশ্য থাকলে তা ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে না। অন্যদিকে আপাতদৃষ্টিতে খারাপ কাজেও ভালো নিয়ত থাকলে সেটা ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ কুরবানি বিষয়ে বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের পশুর রক্ত গ্রহন করবেন না, গোসত গ্রহন করবেন না, গ্রহণ করবেন তাকওয়া (সূরা হজ, আয়াত: ৩৭) গরু, ছাগল, যত বড়ই হোক, সেটা গ্রহণ করবেন না, গ্রহণ করবেন তাকওয়া সহীহ নিয়ত।

কুরবানির গুরুত্বঃ কুরবানি মানুষকে শিক্ষার পাশাপাশি গরিব দুঃখীদের খাদ্য সহায়তার পাশে থাকার সুুযোগদেয়। কুরবানির মাধ্যমে সমাজের গরিব অংশের অধিকাংশই উপকৃত হন। আত্মীয়তা, সামাজিকতা ও ইসলামের মাহত্ম প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে সমাজকে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ করে তোলে।

উপসংহারঃ কুরবানি করার মাধ্যমে বান্দা, আল্লাহ ও ইসলামের জন্য সকল কিছু উৎসর্গ করার ওয়াদা করে। এতে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ লাভ করে। পাশাপাশি সমাজেও এর সুফল পাওয়া যায় বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে। তাই সামর্থ্যবানদের অবশ্যই কুরবানি করা উচিত।

রচনা প্রতিযোগিতায় ক-গ্রুপে ১ম স্থান অধিকারী
রায়হান সিদ্দিক ফয়সাল
১০ম শ্রেণি
ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।