দুনিয়ার মরীচিকা ও কবর

দুনিয়ার মরীচিকা ও কবর

দুনিয়ার মরীচিকা ও কবর

কাফির ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন শেষ করে যখন আখিরাতে পদার্পণ করবে তখন আসমান থেকে আজাবের ফেরেশতা নাজিল হবে। তাদের চেহারা নিকষ কালো। তাদের সাথে কাঁটাযুক্ত কাফনের কাপড় থাকবে। তারা দৃষ্টির শেষ সীমায় এসে বসে। তারপর মালাকুল মউত আসবেন ও তার মাথার কাছে বসবেন এবং বলবেন, হে নিকৃষ্ট আত্মা, আল্লাহর আজাবে লিপ্ত হওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি দেহ থেকে বের হও। কাফিরের রূহ এ কথা শুনে তার গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। তখন মৃত্যুর ফেরেশতা তার রূহকে শক্তি প্রয়োগ করে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসবেন, যেভাবে লোহার গরম শলাকা ভেজা পশম থেকে টেনে বের করা হয়। মালাকুল মউত রূহ বের করে আনার পর অন্যান্য ফেরেশতা এ রূহকে মালাকুল মউতের হাতে এক পলকের জন্য থাকতে দেন না, বরং তারা নিয়ে (কাফনের কাপড়ে) মিশিয়ে দেন। এ রূহ থেকে মরা লাশের দুর্গন্ধ বের হয় যা দুনিয়ায় পাওয়া যেত।

ফেরেশতা এ রূহকে নিয়ে আসমানের দিকে চলে যান। যখন ফেরেশতার কোনো দলের কাছে পৌঁছেন, তারা জিজ্ঞেস করেন, এ নাপাক রূহ কার? ফেরেশতা জবাব দেন, এটা হলো অমুক ব্যক্তির সন্তÍান অমুক। তাকে খারাপ নাম ও খারাপ বিশেষণে ভূষিত করেন, যেসব নামে তাকে দুনিয়ায় ডাকা হতো। এভাবে যখন আসমান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া হয়, তার জন্য আসমানের দরজা খুলতে বলা হয়। কিন্তু আসমানের দরজা তার জন্য খোলা হয় না। ওই কাফিরদের জন্য আসমানের দরজা খোলা হবে না, আর না তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, যে পর্যন্ত উট সুইয়ের ছিদ্রপথে প্রবেশ করবে। এবার আল্লাহ বলবেন, ‘তার আমলনামা সিজ্জিনে লিখে দাও যা জমিনের নিচতলায়।’ বস্তুত কাফিরদের রূহ নিক্ষেপ করে ফেলে দেয়া হয়।

যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করেছে, সে যেন আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। তাকে পশুপাখি ঠুকরিয়ে নেয়। তারপর তার রূহকে তার দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয়। দু’জন ফেরেশতা তার কাছে আসেন। বসিয়ে দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রব কে? বলবে, ‘হায়! হায়! আমি কিছু জানি না’। তারপর তারা দু’জন জিজ্ঞেস করবেন, তোমার দ্বীন কি? সে বলবে, ‘হায়! হায়! আমি কিছু জানি না’। তারপর তারা দু’জন জিজ্ঞেস করেন, ‘এ ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল? সে বলে, ‘হায়! হায়! আমি কিছু জানি না’।

তখন আসমান থেকে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করে বলবেন, ‘এ ব্যক্তি মিথ্যা বলেছে, অতএব তার জন্য আগুনের বিছানা বিছিয়ে দাও, তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটি দরজা খুলে দাও।’ জাহান্নামের গরম বাতাস আসতে থাকবে। তার কবরকে এত সঙ্কীর্ণ করা হবে যে, তার পাঁজরের এদিকের (হাড়গুলো) ওদিকে, ওদিকেরগুলো এদিকে বের হয়ে আসবে। তারপর তার কাছে একটি কুৎসিত চেহারার লোক আসবে, তার পরনে থাকবে ময়লা, নোঙরা কাপড়। তার থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকবে। এ কুৎসিত লোকটি বলতে থাকবে, তুমি একটি খারাপ খবরের সংবাদ শুনো যা তোমাকে চিন্তায় ও শোকে-দুঃখে কাতর করবে। আজ ওই দিন, যেদিনের ওয়াদা তোমাকে করা হয়েছিল।

সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কে? তোমার চেহারা এত কুৎসিত যে, খারাপ ছাড়া কোনো (ভালো) খবর নিয়ে আসতে পারে না। সে লোকটি বলবে, ‘আমি তোমার বদ আমল’। এ কথা শুনে ওই মুর্দা ব্যক্তি বলবে, ‘হে আমার পরোয়ারদিগার। তুমি কিয়ামত কায়েম করো না’ (আহমাদ-১৮৫৩৪, ইবনু আবি শায়বাহ-১২০৫)।

দুনিয়ার জীবন মরীচিকার মিথ্যা আশ্বাস তবুও দুনিয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে কবরের কথা মানুষ ভুলে যায়। কুরআনে এসেছে, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরসমূহে উপস্থিত হচ্ছো’ (সূরা তাকাছুর : ০১-০২)।

বারজাখ বা কবরের জীবন কিয়ামত পর্যন্ত সামান্য বিরতির স্থান মাত্র। আর যার কবরের জীবন সহজ হবে তার পরবর্তী ধাপ পাড়ি দেয়া তত সহজ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলে, ‘হে আমার রব! আমাকে পুনরায় প্রেরণ করুন, যাতে আমি আমার ছেড়ে আসা জীবনে সৎকর্ম করতে পারি।’ না, এটা হওয়ার নয়; এটা তো তার একটা উক্তি মাত্র; তাদের সামনে ‘বারজাখ’ (যবনিকা) থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (সূরা মুমিনুন : ৯৯-১০০)।

রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয় কবর হলো আখিরাতের মঞ্জিলগুলোর মধ্যকার সর্বপ্রথম মঞ্জিল। কেউ যদি এখান থেকে রেহাই পায়, তবে তার জন্য পরবর্তী মঞ্জিলগুলো কবরের চেয়েও সহজতর হবে। আর সে যদি এখান থেকে রেহাই না পায়, তবে তার জন্য পরবর্তী মঞ্জিলগুলো আরো ভয়াবহ হবে। আমি কখনো এমন কোনো দৃশ্য অবলোকন করিনি যার তুলনায় কবর অধিক ভয়ঙ্কর নয়’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৪২৬৭)।

মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমন তিনটি সময় রয়েছে যে সময় নবী সা: সালাত আদায় করতেন না। এ সময়ে মৃতকে কবর দিতে নিষেধ করেছেন। সময় তিনটি হলো, সূর্য উজ্জ্বল হয়ে উঠা হতে কিছুটা উপরে উঠা পর্যন্ত এবং ঠিক দুপুর হলে যে পর্যন্ত না সূর্য ঝুঁকে পড়ে। আর যখন সূর্য ঝুঁঁকে পড়ে অস্ত যাওয়ার উপক্রম হয়’ (বুলুগুল মারাম-১৬৪)। সর্বপ্রথম কবর থেকে উত্থিত হবেন রাসূল সা: এবং তিনিই সবার জন্য সুপারিশ করার সুযোগ পাবেন।

রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমি কিয়ামতের দিন আদম সন্তানদের সরদার হবো এবং আমিই প্রথম ব্যক্তি যার কবর খুলে যাবে এবং আমিই প্রথম সুপারিশকারী ও প্রথম সুপারিশ গৃহীত ব্যক্তি’ (সহিহ মুসলিম-৫৮৩৪)। তিনি কবরের মৃত ব্যক্তিদের জন্য যখনই কবরস্থানে হেঁটে যেতেন দোয়া করতেন। আর আমাদেরকেও এই দোয়া করতে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলতেন, ‘হে কবরবাসী, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিন, তোমরা আমাদের অগ্রগামী আর আমরা তোমাদের পশ্চাতে গমনকারী’ (বুলুগুল মারাম-৫৯৬)।

কবর হচ্ছে মৃতদের জন্য একটি আশা বা হতাশার স্থান। কারণ কবরে থেকেই প্রত্যেক ব্যক্তি দর্পণের মতো অবলোকন করবে তার আমলনামা এবং তার জন্য নির্ধারিত স্থান। ‘তোমাদের কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে, কবরে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় তার জান্নাত অথবা জাহান্নামের ঠিকানা তার সামনে পেশ করা হয়। আর বলা হয় যে, এই হলো তোমার ঠিকানা, তোমার পুনরুত্থান পর্যন্ত’ (সহিহ বুখারি-৬৫১৫)।

কবরের আজাব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় কতটা ভয়াবহ সেই আজাব। কিন্তু ভালো কিছু আমল কবরের আজাব কমিয়ে দিতে পারে। রাসূল সা: বলেন, ‘সদকাহ অবশ্যই কবরবাসীর কবরের উত্তাপ ঠাণ্ডা করে দেবে এবং মুমিন কিয়ামতে তার ছায়াতে অবস্থান করবে’ (তাবারানির কাবির-১৪২০৭)। ‘কবরস্থানে নামাজ পড়তে, তার ওপর বসতে নিষেধ করা হয়েছে। কবরস্থান ও গোসলখানা ব্যতীত পৃথিবীর সব জায়গাই সালাত আদায়ের স্থান’ (বুলুগুল মারাম-২১৫)।রাসূল সা: একদা মদিনা বা মক্কার বাগানগুলোর মধ্য থেকে কোনো এক বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এমন দুই ব্যক্তির আওয়াজ শুনতে পেলেন, যাদেরকে কবরে আজাব দেয়া হচ্ছিল। এদের দু’জনকে আজাব দেয়া হচ্ছে, অথচ কোনো গুরুতর অপরাধে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। এদের একজন পেশাব করতে গিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করত না।

অপর ব্যক্তি চোগলখোরি করত। অতঃপর তিনি একটি খেজুরের ডাল আনতে বললেন এবং তা ভেঙে দুই টুকরা করে প্রত্যেকের কবরের ওপর এক টুকরা করে রাখলেন। আশা করা যেতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত এ দু’টি শুকিয়ে না যায় তাদের আজাব কিছুটা হালকা করা হবে’ (সহিহ বুখারি-২১৬)। নবী সা: বলেছেন, ‘কুরআনের মধ্যে ৩০ আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা আছে যেটি কারো পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে মাফ করে দেয়া হয়। এ সূরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক’ (তিরমিজি-২৮৯১)।