পাবনায় পেঁয়াজ উৎপাদন কম হওয়ায় দুশ্চিন্তায় চাষিরা

পাবনায় পেঁয়াজ উৎপাদন কম হওয়ায় দুশ্চিন্তায় চাষিরা

পাবনায় পেঁয়াজ উৎপাদন কম হওয়ায় দুশ্চিন্তায় চাষিরা

এম মাহফুজ আলম, পাবনা: দেশের মোট চাহিদার এক চতুর্থাংশই পেঁয়াজ পাবনায় উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু আশা-দূরাশায় দিন কাটাচ্ছেন পাবনার পেঁয়াজ চাষিরা। আশার কথা হচ্ছে পেঁয়াজের বাজার ভালো। কয়েকদিন ধরে মূলকাটা বা মুড়ি পেঁয়াজ বাজারে উঠেছে। এটা কন্দ পেঁয়াজ হিসেবেও পরিচিত। চাষি মূলকাটা বা মুড়ি  পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেছে। পুরাতন পেঁয়াজের পাশাপাশি বাজারে নতুন ওঠা পেঁয়াজেরও দাম  মোটামুটি ভালো।

মুড়ি পেঁয়াজের যত্ন পরিচর্যা নিয়ে চাষিরা এখন মহাব্যস্ত। মুড়ি পেঁয়াজ পুরাদমে বাজারে উঠেলে দাম পড়ে যায় কি না বা সরকার আবার আমদানি করে কি না এ নিয়ে চাষিরা চিন্তিত। পেঁয়াজ আমদানি করলে ক্ষতির শিকার হতে হবে বলে চাষিরা জানিয়েছেন।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পাবনা জেলায় এবার ৯ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমিতে কন্দ বা মূলকাটা পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কন্দ পেঁয়াজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন।

গত বছর এবং এবার মৌসুমের শেষে এসে পেঁয়াজের ভালো দাম পেয়েছেন চাষিরা। এজন্য কৃষকেরা এবার  পেঁয়াজ চাষে আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। এবছর পাবনায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি বিভাগ আশা করছে।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পাবনা জেলা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন যা মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। আর পাবনা  জেলার সাঁথিয়া-সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টন। এ হিসেবে সারাদেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক পঞ্চমাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার এ দু’টি উপজেলায়।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জেলার চাষিরা দু’টি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ করে থাকেন। এর একটি কন্দ (মূলকাটা বা মুড়ি) ও অন্যটি চারা (হালি) পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আর হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। মূলকাটা পদ্ধতিতে আবাদ করা নতুন পেঁয়াজ জানুয়ারি মাসে হাটে উঠতে শুরু করে। আর হালি পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ হাটে ওঠে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত।

শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগর উপেজলার বিল গ্যারকাপাড়, বিল গাজনা পাড়, কুমিরগাড়ী, বামনডাঙ্গা, বামনদি, ইসলামপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায় চাষিরা পেঁয়াজ চাষ আর পরিচর্যায় মাহাব্যস্ত। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ পেঁয়াজের মাঠে।

বাড়ির নারীরাও পুরুষ সদস্যদের কাজে সহায়তা করছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা শেষে বন্ধ থাকায় অনেক শিশুদের বড়দের সাথে পেঁয়াজ ক্ষেতে পরিচর্যায় দেখা গেছে।

পেঁয়াজ চাষিরা জানান, এ সময় কৃষি শ্রমিকের দাম বেড়ে গেছে। তাই পরিবারের সবাই এ কাজে সহযোগিতা করছেন।

দেশের অন্যতম বড় পেঁয়াজের হাট সাঁথিয়ার বনগ্রাম হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি মণ পুরাতন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা দরে। কন্দ পেঁয়াজ এখনও তেমন উঠতে শুরু করেনি। আগাম চাষ করা দু’চারজন কৃষক বাজারে এনেছেন। সে নতুন পেঁয়াজও প্রতি মণ এক হাজার থেকে ১ হাজার ৩শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।

আতাইকুলা থানার কুমিরগাড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মিল্লাদ হোসেন জানান, এখন পেঁয়াজ চাষে অনেক খরচ। এছাড়া অনেক ছোট-বড় চাষি চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও পেঁয়াজ চাষ করেন।

নতুন পেঁয়াজ পুরোদমে বাজার উঠলে দাম একটু কমে যাবে বলে তারা অভিজ্ঞতার আলোকে জানান। তারা বলেন, মূলকাটা বা কন্দ পেঁয়াজ ১ হাজার ৫শ’ টাকা মণ বিক্রি করা না গেলে চাষিরা ক্ষতির শিকার হবেন। তিনি জানান, প্রতি হাটেই এখন আবার পেঁয়াজের দাম কমা শুরু করেছে। এ নিয়ে তারা চিন্তিত।

সাঁথিয়া উপজেলার ভৈরবপুর গ্রামের চাষি আমজাদ হোসেন জানান, এক বিঘা জমিতে মূলকাটা পেঁয়াজ আবাদ করতে পেঁয়াজ কেনাসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ৩৫-৩৬ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। মৌসুমে মণ প্রতি ২হাজার টাকা বাজার থাকলে চাষির পোষায়।

ভৈবরবপুর গ্রামের আরেক চাষি জালাল উদ্দিন জানান, তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে মুড়ি পেঁয়াজ কাষ করেছেন। তার ১১ মণ পেঁয়াজ লেগেছে। তিনি ২৫০০-২৬০০ টাকা মণ দরে ছোট পেঁয়াজ কিনে লাগিয়েছেন তিনি জানান চাষের খরচ, লাগানো খরচ, তোলা খরচ, সার বিষের খরচ সব মিলিয়ে তার খরচ ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে  গেছে। তিনি আরো বলেন, দাম বাড়লেই সরকার পুলিশ দিয়ে দাম কমিয়ে দেয় বা আমদানি শুরু করে। তিনি জানান, মৌসুমে দু’হাজার টাকা মণ না হলে তার ক্ষতি হবে। তার জমিতে ৫০ মণ পেঁয়াজ হবে বলে তিনি আশা করছেন।

বাংলাদেশ ফার্মার্স এসোসিয়েশন (বিএফএ)-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পাবনা জেলার বিশিষ্ট চাষি শাহজাহান আলী বাদশা জানান, চাষিরা বাপ-দাদার আমল থেকে চাষ করে আসা পেঁয়াজের জাতই চাষ করে আসছেন। ফলে বিঘা প্রতি ফলন একই রকম হারে রয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা বেড়েছে, পেঁয়াজের চাহিদাও বেড়েছে। তাই বিঘা প্রতি ফলন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য অন্যান্য ফসলের মত পেঁয়াজের উফশী জাত (উচ্চ ফলনশীল) সম্প্রসারণ করা দরকার।

পাবনার দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ জাফর সাদেক জানান, বছরের শেষ দিকে অনেক সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে। তবে সে দাম সাধারণ চাষিরা পান না। কারণ চাষের খরচজনিত দেনার কারণে তাদের মৌসুমের শুরুতেই সিংহভাগ পেঁয়াজ বেচে ফেলতে হয়। বাধাইকারকরা বেশি দাম ধরতে পারে। তিনি জানান, পেঁয়াজ চাষে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার সরকারি ঘোষণা থাকলেও সাধারণ চাষিরা সে সুবিধা পাচ্ছেন না। অনেকেই চড়া সুদে মহাজনী ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মিজানুর রহমান জানান, এবার আবহাওয়া ভালো। কৃষির মাঠকর্মীরা চাষিদের সবসময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

তিনি জানান, পাবনায় দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদনও বাড়ছে। উন্নত জাতও উদ্ভাবিত হয়েছে। তবে সেগুলো দীর্ঘ মেয়াদে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। চাষি পর্যায়ে পৌঁছাতে সঙ্গত কারণেই সময় লেগে যায়। তিনি জানান, বিগত কয়েক বছর ধরেই চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। এবারও তারা নায্য দাম পাবেন বলে তারা আশাবাদী।