বিক্ষোভে উত্তাল ভারত: প্রতিবাদের মুখে নাগরিকত্ব আইনের নতুন ব্যাখ্যা

বিক্ষোভে উত্তাল ভারত: প্রতিবাদের মুখে নাগরিকত্ব আইনের নতুন ব্যাখ্যা

ছবি: সংগ্রহীত

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। উত্তপ্ত উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তিন দিনের সহিংসতায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন।

এদিকে, ব্যাপক ও অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক তালিকা নিয়ে সুর নরম করেছে বিজেপি সরকার। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গত সপ্তাহে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন পাস করার পর থেকে দেশটির বিভিন্ন স্থানে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। সংঘর্ষে এ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে উত্তর প্রদেশে ১০ জন, আসামে তিনজন, বেঙ্গালুরুতে দু’জন এবং লখনৌতে একজন নিহত হয়েছেন। শনিবার উত্তর প্রদেশে একজন নিহত হন।

ভারতজুড়ে তিন দিনে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এদিকে শনিবার ভিম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ। সংঘর্ষের কারণে জেলায় জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দিল্লির জামিয়া মিলিয়ার শিক্ষার্থীরা ফের বিক্ষোভ শুরু করার খবর পাওয়া গেছে। আনন্দবাজার, এনডিটিভি, বিবিসি, এএফপি ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর।

বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ ঘিরে উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তর প্রদেশ সবচেয়ে বেশি অশান্ত হয়ে উঠেছে। এখানে শুক্রবার প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। শনিবার সকাল থেকে রাজ্যের রামপুরে বিক্ষোভ শুরু হয়। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এদিন একজন নিহত হয়।

শুক্রবারের সংঘর্ষের পর লখনৌ, বিজনৌর, মেরঠ, ফিরোজাবাদ, কানপুর, সম্বল, মোরাদাবাদ, আলিগড়, বরেলি, প্রয়াগরাজসহ (ইলাহাবাদ) রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। সিএএর বিরুদ্ধে বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) নেত্রী মায়াবতী সরব হয়েছেন। কেন্দ্রের কাছে এ আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সিএএ ঘিরে এনডিএ জোটের মধ্যেই মতপার্থক্য তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার জন্য তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানান।

উত্তর প্রদেশের মতো উত্তপ্ত পরিস্থিতি না হলেও উত্তেজনা রয়েছে দিল্লিতেও। শনিবার ভিম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ। এ সময় আরও ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ‘মিশন চন্দ্রশেখর’ সফল হলেও দিল্লি পুলিশকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ ফের বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন জামিয়া মিলিয়ার শিক্ষার্থীরা। দিল্লি পুলিশ সূত্র জানায়, জামা মসজিদ চত্বর থেকে আজাদকে গ্রেফতার করা হয়।

তার বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া প্রতিবাদ মিছিল এবং সহিংসতায় মদদ দেয়ার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে। শুক্রবার জামা মসজিদ থেকে যন্তরমন্তর পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিলে জড়ো হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর জামা মসজিদেই আশ্রয় নেন আজাদ। সহিংসতায় মদদ দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আজাদ বলেছেন, আমাদের আত্মোৎসর্গ করতে হবে যাতে সরকার এ আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আমরা সহিংসতায় বিশ্বাস করি না। ১৫ ডিসেম্বর পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের খণ্ডযুদ্ধে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর থেকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলে আসছে। শনিবার ওই বিক্ষোভ সপ্তম দিনে পড়েছে।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে নতুন ব্যাখ্যা : ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শুক্রবার বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া ব্যাখ্যায় নাগরিকত্ব পাওয়ার কয়েকটি শর্ত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে যারা ভারতে জন্মেছেন তারা সবাই ভারতের নাগরিক। এ ছাড়া ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে যারা জন্ম নিয়েছেন এবং যাদের বাবা-মায়ের মধ্যে কোনো একজন ভারতের নাগরিক তিনিও ভারতীয়। পাশাপাশি ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর যারা জন্মেছেন এবং যাদের বাবা-মা দু’জনেই ভারতের নাগরিক কিংবা একজন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্যজন একই সময়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’ নন, তারাও ভারতের নাগরিক হিসেবেই গণ্য হবেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, দেশজুড়ে এনআরসি চালু করার সময় যে নিয়মকানুন তৈরি হবে, তাতে বৈধ নাগরিকদের কারও কোনো সমস্যা হবে না। জন্মের নথি বা স্কুলে পড়ার নথি দাখিলের মাধ্যমে নাগরিকত্বের আবেদন করা যাবে। নিরক্ষর ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। তাদের ক্ষেত্রে জন্মের সাক্ষী থাকা কোনো ব্যক্তি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রশংসাপত্রের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের আবেদন করা যাবে। দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরি হওয়ার পর তাতে নাম উঠলে মিলবে ন্যাশনাল সিটিজেনশিপ কার্ড (এনসিসি)। ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড নয়, এনসিসিই হবে এ দেশের নাগরিক হওয়ার পরিচয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাখ্যা নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অনেকে। তাদের ভাষ্য, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে জন্মের নথি বাধ্যতামূলক ছিল না; নথি না থাকলে তারা এখন কী দেখাবেন? এ ছাড়া ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের পরে জন্মানো কেউ যদি বাবা বা মায়ের মধ্যে কোনো একজনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে না পারেন তা হলে তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু তিনি যেহেতু ভারতে জন্মেছেন, তাই অমুসলিম হলেও নিজেকে শরণার্থী হিসেবে দাবি করে নয়া নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা নিতে পারবেন না। শুক্রবার ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা এসব তথ্য জানান। আসামের ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের সময় ছিল ১৯৭১ সাল।