পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার কী, যেভাবে হয়, যা করা যেতে পারে

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার কী, যেভাবে হয়, যা করা যেতে পারে

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার কী, যেভাবে হয়, যা করা যেতে পারে

ধরুন আপনি কোন দুর্ঘটনা, সহিংসতা, দুর্যোগের শিকার হয়েছেন, মর্মান্তিকভাবে প্রিয় কারো মৃত্যু দেখেছেন, এরকম কোন ধরনের ভীতিকর ও কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলে অনেকেই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডিতে আক্রান্ত হন।

নিজে কোনও কিছুর শিকার না হয়েও চোখের সামনে প্রিয় কেউ বা সম্পূর্ণ অজানা কারো প্রতি ভয়াবহ কিছু ঘটতে দেখলেও এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভব।

এতে আক্রান্ত হলে যা ঘটে

সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, "একজন মানুষের ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা নানা কারণে হতে পারে। যেমন পারিবারিক সহিংসতা, কারো মৃত্যুতে তীব্র মানসিক আঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, ধর্ষণ, সহিংস অপরাধ, দুর্ঘটনা এরকম নানা ভয়াবহ কিছু তার ক্ষেত্রে ঘটেছে বা সে ঘটতে দেখেছে"।

"এরকম কিছুর প্রতি এটা এক ধরনের প্রতিক্রিয়া যা সাধারণত ঘটনার তিন মাসের মাথায় দেখা দেয়। ঘটনার সাথে সাথেই পিটিএসডি হয় না।"

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস মেডিসিন বলছে, এতে আক্রান্ত হলে যে ঘটনার কারণে এটা হয়েছে একজন মানুষ যেন বারবার ওই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন এমন অনুভব করেন, আবার ঘটতে যাচ্ছে এরকম আতঙ্ক বোধ করে।

ওই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত অনেক কিছু মনে করতে পারেন না, সাময়িক স্মৃতি ভ্রম তৈরি হয়, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখেন।ওই ঘটনা মনে করিয়ে দিতে পারে এমন যেকোনো কিছু শুনলে বা দেখলে তীব্র প্রতিক্রিয়া, আতঙ্ক, উদ্বেগ বোধ করেন, চমকে ওঠেন।

ঘটনাটি মনে করিয়ে দিতে পারে এমন কিছু এড়িয়ে চলেন।

 

পিটিএসডিতে আক্রান্ত হলে আচরণগত পরিবর্তন হতে পারে।

এতে আক্রান্ত অনেকেই ক্রোধ বোধ করেন।

আবেগ অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।

দুশ্চিন্তা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

বিরক্তি বোধ করেন, অনিদ্রায় ভোগেন।

সঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পারেন না।

এর শারীরিক প্রতিক্রিয়াও হয়ে থাকে যেমন নিশ্বাস নিতে কষ্ট, বমি, ঘাম হওয়া ইত্যাদি।

অনেকেই এর কারণে মাদকাসক্ত হয়ে ওঠেন।"সবার ক্ষেত্রেই যে পিটিএসডি হবে তা নয়। কারোর মধ্যে মানসিক কোন সমস্যা আগে থেকেই ছিল কিনা, ঘটনার ভয়াবহতা কতটা ছিল, এমন ঘটনা মোকাবেলা করার মানসিক ক্ষমতা তার কতটুকু এরকম অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে কেউ পিটিএসডিতে আক্রান্ত হবেন কি না বা তার মাত্রা কেমন হবে। নারীদের এটি বেশি হয়ে থাকে", বলছিলেন ইশরাত শারমিন।

কয়েকজনের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে ২০১৪ সালের রানা প্লাজা ভবন ধসে আহত, ভবনের নিচে আটকে পড়া শ্রমিক এবং উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই পরবর্তীতে পিটিএসডিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল সেই ঘটনায় আহত অনেকেই পোশাক কারখানায় ঢোকার পর আতঙ্ক বোধ করতেন।সেকারণে অনেকেই পোশাক কারখানায় চাকরি করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের এক গবেষণায় দেখা গেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ২৪ শতাংশ চিকিৎসক বিভিন্ন মাত্রার পিটিএসডিতে আক্রান্ত হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধফেরত অনেক সেনা সদস্যের মধ্যে অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত এটি।সবসময় এত গুরুতর কোন অভিজ্ঞতা না হলেও অপেক্ষাকৃত কম ভয়াবহ কোন অভিজ্ঞতার কারণেও এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বাংলাদেশের একটি নামি কোম্পানিতে কাজ করেন এমন একজন বছর কয়েক আগে একটি অস্ত্রোপচার চলাকালীন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।এর পরবর্তীতে তার মধ্যে সেই অভিজ্ঞতা যে মানসিক সমস্যা তৈরি করেছিল সেটিকে পিটিএসডি বলে নির্ণয় করা হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নারী বলছিলেন, অস্ত্রোপচার করে তার গর্ভাশয় ফেলে দেবার জন্য ঢাকার একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।

'লোকাল অ্যানেসথেশিয়া' দিয়ে শরীরের নিচের অংশ অবশ করে সেই অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল।কিন্তু তাকে কোন ধরনের ব্যথানাশক দিতে ভুলে গিয়েছিলেন সেখানে উপস্থিত চিকিৎসক ও নার্স।এর পরবর্তীতে যে অভিজ্ঞতা তার হয়েছে এখনো তার প্রভাব তার মধ্যে রয়ে গেছে।

ঘটনার বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন, "অপারেশন শেষে যখন অ্যানেসথেশিয়ার এফেক্ট কমে আসছিল, পেটের কাটা অংশে, পেটের ভেতরে এত ভয়াবহ ব্যথা শুরু হয়েছিল যে আমি চিৎকার করছিলাম। সেই ব্যথা অবস্থায় ওরা আমার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করেছিল, ধমক দিয়ে বলতে শুরু করলো এই বুড়ি মহিলা এরমক ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন কেন? পোস্ট অপারেটিভে নিয়ে মনে হল যেন রাগে আমাকে বেডে ছুঁড়ে ফেলে দিলো"।

"তারপর তাদের মনে পড়লো যে আমাকে প্যাথেড্রিন দেয়া হয়নি। যখন প্যাথেড্রিন ইনজেকশন দিচ্ছে তখনো আমাকে ওই ব্যথা অবস্থায় ধাক্কা দিয়ে বলছিল এই মহিলা দেখি হাত দেন। আমার স্বামী ওটির বাইরে থেকে আমার চিৎকার শুনতে পেয়েছিল।"এর পরবর্তীতে দীর্ঘদিন রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তিনি।

"ওই ঘটনার পরে আমি প্রায় রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখতাম যে চারজনে মিলে হাত পা ধরে আমাকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলছে। বিছানায় ধপ করে পড়া রীতিমতো আমি অনুভব করতাম। ওই হাসপাতালের প্রেসক্রপিশন, ফাইল, লোগো দেখলেও সেই অভিজ্ঞতা মনের মধ্যে আবারও ফিরে আসতো। হাসপাতালের সামনের রাস্তা দিয়ে যেতেও আতঙ্কিত বোধ করতাম।"

ঢাকার মিরপুরের এক বাসিন্দার সাথে কথা হচ্ছিল যাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গুরুতর উপসর্গ নিয়ে দশদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল।সেখানে রোজ আশপাশে তার চেয়েও গুরুতর রোগীদের মৃত্যু দেখেছিলেন তিনি।

প্রতিদিন সেই মরদেহ বিছানায় পড়ে থাকা, সেগুলো কাপড়ে মুড়ে সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে দেখা, স্বজনদের কান্না তার মনোজগতের উপরে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল।

"আমি এখন আর হাসপাতালে ঢুকতে পারি না। ঢুকলেই মনে হয় যেন পা সামনে আগায় না। মেঝেতে যেন পা আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমার বার্ধক্যজনিত কিছু অসুখ আছে। ডাক্তারের কাছে না গেলেতো চলে না। তাই আমাকে এই অনুভূতি ম্যানেজ করতে হয়।", বলছিলেন তিনি।কম গুরুতর হলেও তার এইসব অভিজ্ঞতা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বলে মনে করেন ইশরাত শারমিন রহমান।

যে সহায়তা আক্রান্তদের প্রয়োজন

বাংলাদেশে মানসিক সমস্যা সাধারণভাবেই উপেক্ষিত একটি বিষয়।পিটিএসডিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহসা গুরুত্ব দেয়া হয় না।সে কারণে বিষয়টি চিহ্নিত হয় না।

ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, এমন ব্যক্তিদের ঘটনার পরপরই যদি সহায়তা দেয়া হয় তাহলে এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাদেরকে ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা এবং নিয়মিত কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে।পরিবার, স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীর ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

"আমি এমনও দেখেছি যে ধর্ষণের শিকার একটি মেয়ে পরিবারের সদস্যরাই তাকে নানা কথা বলে ট্রমা বাড়িয়ে দিচ্ছে সাহায্য তো দুরে থাক। দেখা যায় পিটিএসডির শিকার ব্যক্তির আচরণগত পরিবর্তনের কারণে পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। প্রতিবেশীরা বলে ফেলছে লোকটা আঘাতে পাগল হয়ে গেছে। এসব কারণে তার ক্ষত কিন্তু আরও গভীর হতে থাকে", বলছিলেন তিনি।

সূত্র  : বিবিসি