জাল স্ট্যাম্প জব্দ, গ্রেপ্তার ১০

জাল স্ট্যাম্প জব্দ, গ্রেপ্তার ১০

সংগৃহিত ছবি।

বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কাজের সময় স্ট্যাম্প ভেন্ডারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সোহেল কাজীর (৩১)। এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে সাভারের আশুলিয়ায় ‘কনফিডেন্স প্রিন্টিং’ প্রেস নামের প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মুদ্রণ শুরু করেন তিনি। রেভিনিউ স্ট্যাম্প মুদ্রণের পর মেশিনের মাধ্যমে কাটিং ও ছিদ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতেন সোহেল।

গতকাল মঙ্গলবার (১৩ জুন) রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-৪-এর একটি দল ঢাকার আশুলিয়া ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা মো. সোহেল কাজীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. সোহেল কাজী (৩১), মো. জাহাঙ্গীর আলম ওরফে জাহিদ (৪০), মো. সোহেল রানা (৩৫), মো. সাব্বির হোসেন (২২), মোছা. সাবিনা ইয়াছমিন (৩০), মোছা. শাহনাজ আক্তার (৩১), কামরুল হাসান (২৬), মো. সুমন (২২), বিল্টু (১৯) ও  মো. সেন্টু মিয়া (২৫)। তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।

এ বিষয়ে আজ বুধবার (১৪ জুন) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, সোহেলের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত আরও কয়েকজন। চক্রটির সঙ্গে বিভিন্ন অনুমোদিত ভেন্ডারদের সুসম্পর্ক থাকায় তাঁরা সব অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করতেন। ২ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো এসব জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প। প্রতি মাসে ৮ থেকে ১০ রিম কাগজের এসব অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করত চক্রটি। চক্রের সদস্যরা এই টাকা দিয়ে গড়েছেন বাড়িসহ বিভিন্ন সম্পত্তি। আর এতে বছরে ২২ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার।

এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা মূল্যমানের ৩ লাখ ৮০ হাজার ৮৬০টি স্ট্যাম্প, ২০০ টাকা মূল্যমানের ৬২ হাজার স্ট্যাম্প, ১০০ টাকা মূল্যমানের ৯২ হাজার ২০০টি স্ট্যাম্প, ৫০ টাকা মূল্যমানের ৬০ হাজার ৭৬০টি স্ট্যাম্প, ২০ টাকা মূল্যমানের ৩২ হাজার ২০০টি স্ট্যাম্প, ১০ টাকা মূল্যমানের ৪ লাখ ২১ হাজার ৯০০টি স্ট্যাম্প, ৫ টাকা মূল্যমানের ৯ হাজার স্ট্যাম্প, ৪ টাকা মূল্যমানের ৩৬ হাজার ৯০০টি স্ট্যাম্প, ২ টাকা মূল্যমানের ৫‌ হাজার ৬০০টি স্ট্যাম্প, পারফেক্ট মেশিন ৩টি ও স্ট্যাম্প তৈরির পেটেন্ট ২০টিসহ মোট ২২ কোটি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যমানের ১১ লাখ ১ হাজার ৪২০টি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও নগদ ৩০ হাজার ৭৪৫ টাকা এবং বিপুল পরিমাণ অন্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, চক্রটি প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকার আশুলিয়ার বলিভদ্র এলাকায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এভাবে তারা প্রতারণার মাধ্যমে সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে আসছিল। চক্রটি মূলত সোহেল কাজীর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি ও বিক্রিতে সহযোগিতা করত। সোহেল বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করার সুবাদে সেখান থেকে তিনি বিভিন্ন রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির শেখেন। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প চিহ্নিতকরণ সহজ না হওয়ায় এবং অধিক মুনাফা লাভের আশায় তিনি নিজ ব্যবস্থাপনায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি ও বিক্রি করতেন। আশুলিয়ার ‘কনফিডেন্স প্রিন্টিং’ প্রেসের মালিক ও অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে এই কাজ করে আসছিলেন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, কনফিডেন্স প্রিন্টিং প্রেসে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মুদ্রণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন গ্রেপ্তার হওয়া সাব্বির, সুমন, কামরুল সেন্টু ও বিল্টু। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মুদ্রণের পর পারফেক্ট মেশিনের মাধ্যমে কাটিং ও ছিদ্র করা হতো। পরবর্তী সময় জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, গুলশান, সাভার, টঙ্গীসহ  দেশের বিভিন্ন আদালতে কোর্ট ফি ও অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করা হতো।

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, বিভিন্ন সময় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করার সুবাদে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করতে পারেন—এমন অনেক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। এভাবে তাঁরা ১০-১৫ জনের একটি চক্র গড়ে তোলেন। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন অনুমোদিত ভেন্ডারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় তিনি তাঁদের কাছে কমমূল্যে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতেন। ভেন্ডাররা এসব অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করতেন।

চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে খন্দকার মঈন বলেন, সোহেল কাজী প্রায় ১৬ বছর আগে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কাজ শুরু করেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রায় দুই বছর যাবৎ চক্রটি অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি তৈরি ও বিক্রয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। একপর্যায়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির চাহিদা বেড়ে গেলে সোহেল কাজী এই কাজে স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিনসহ স্ত্রীর বড় ভাই সোহেল রানাকেও সম্পৃক্ত করে। তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিন বাসা থেকে মালামাল ডেলিভারি ও আর্থিক বিষয় দেখাশোনা করতেন। প্রিন্টিং প্রেসে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি মুদ্রণের পর সোহেল রানার বাসায় পারফেক্ট মেশিনের মাধ্যমে কাটিং ও ছিদ্র করাসহ পরবর্তী ধাপের কার্যক্রম সম্পন্ন করতেন। এ ছাড়া তাঁর একটি নিজস্ব ট্রাক রয়েছে। এই ট্রাকের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মালামাল পরিবহনের আড়ালে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করতেন।

র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তার জাহাঙ্গীর পাঁচ-ছয় বছর আগে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে একটি প্রেসের কারখানায় কাজ শুরু করেন। সোহেলের সঙ্গে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত হন। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করে জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে তা রাজধানীর বনানী, গুলশান, উত্তরা, টঙ্গী, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর পরিচিত ভেন্ডারদের কাছে বিক্রি করা হতে। তাঁর স্ত্রী শাহনাজ স্বামীর সহযোগী হিসেবে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি, বিক্রয় ও বহনকারী হিসেবে সহযোগিতা করতেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে মানিকগঞ্জ জেলা সদরে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন।