বিজেপিকে ঠেকাতে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ ফর্মুলার প্রয়োগ চাইছেন বিরোধীরা

বিজেপিকে ঠেকাতে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ ফর্মুলার প্রয়োগ চাইছেন বিরোধীরা

বিজেপিকে ঠেকাতে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ ফর্মুলার প্রয়োগ চাইছেন বিরোধীরা

বিজেপিকে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কীভাবে ঠেকানো সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা করতে আগামিকাল শুক্রবার (২৩শে জুন) বিহারের রাজধানী পাটনায় ভারতের প্রায় কুড়িটি বিরোধী দলের নেতানেত্রীরা এক বৈঠকে বসছেন।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, জনতা দল (ইউনাইটেড) বা জেডি (ইউ) প্রধান নীতীশ কুমার এবং উপমুখ্যমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) নেতা তেজস্বী যাদবের উদ্যোগে বিরোধী দলগুলোর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।বৈঠকের অনেক আগে থেকেই দেশের বিরোধী নেত্রানেত্রীদের ছবি, পোস্টার আর ব্যানারে পাটনা শহর ছেয়ে গেছে। ভারতের রাজনৈতিক মহলও গভীর আগ্রহ নিয়ে পাটনার এই বৈঠকের দিকে নজর রাখছে।

নীতীশ কুমার ও তেজস্বী যাদব ছাড়াও এই বৈঠকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও দলীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, ডিএমকে নেতা তথা তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন, এনিসিপি নেতা শারদ পাওয়ার, শিবসেনার (উদ্ধব গোষ্ঠী) নেতা উদ্ধব ঠাকরে, আম আদমি পার্টির নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং সমাজবাদী পার্টির প্রধান তথা উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব যোগ দেবেন বলে কথা রয়েছে।

তবে দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দল – বহুজন সমাজ পার্টি (বসপা), অন্ধ্রে ক্ষমতাসীন ওয়াই এস আর কংগ্রেস এবং ওড়িশায় ক্ষমতাসীন বিজু জনতা দলকে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন জেডি (ইউ) মুখপাত্র কে সি ত্যাগী।মমতা ব্যানার্জি ও এম কে স্টালিনের মতো কোনও কোনও নেতা বিশেষ চার্টার্ড প্লেনে আজই (বৃহস্পতিবার) পাটনা পৌঁছে যাচ্ছেন। বাকিরা বিহারে এসে নামবেন শুক্রবার।

মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর ভাইপো ও রাজনৈতিক উত্তরসূরী বলে পরিচিত অভিষেক ব্যানার্জিও পাটনায় যাচ্ছেন বলে কলকাতার ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা রিপোর্ট করেছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দশ মাস বাদে দেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে এতজন বিরোধী নেতা-নেত্রীর এক মঞ্চে আসার ঘটনা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই – কিন্তু সারা দেশে তা বিরোধী ঐক্য নিশ্চিত করতে পারবে কি না সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়।

ভোটের পাটিগণিত

প্রথমবার নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০১৪ সালের যে নির্বাচনে জিতে, সেবারে তার দল গোটা দেশে ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এর পাঁচ বছর বাদে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৭.৪ শতাংশ ভোট।ওই দুটি নির্বাচনেই বিজেপি একক শক্তিতে লোকসভায় গরিষ্ঠতা অর্জন করে – যা দেখিয়ে দিয়েছে মোট প্রদত্ত ভোটের এক তৃতীয়াংশের কিছু কম-বেশি ভোট পেলেও দেশের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তা যথেষ্ট।আর এটা সম্ভব হয়েছে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে ভোট ভাগাভাগির ফলে, সম্মিলিতভাবে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েও বিজেপি-বিরোধী দলগুলো গরিষ্ঠতার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি।

নির্বাচনী বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, ভারতে যেহেতু ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে ভোট হয় (অর্থাৎ একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন তিনিই জয়ী হবেন, অর্ধেকেরে বেশি ভোট পাওয়াটা জরুরি নয়) – তাই প্রধান দলকে পর্যুদস্ত করতে হলে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য আর বোঝাপড়া থাকাটা খুব জরুরি।অন্যভাবে বললে, এদেশে আইওইউ বা ‘ইনডেক্স অব অপোজিশন ইউনিটি’ যত শক্তিশালী হয়, প্রধান দলকে ততটাই বেকায়দায় ফেলা সম্ভব হয়।

ফলে ঠিক এই লক্ষ্য নিয়েই পাটনায় বিজেপি-বিরোধী দলগুলোর নেতারা এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন, যাতে তাদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগিতে আরও একবার বিজেপির সুবিধা না-হয়ে যায়।জেডি (ইউ) সূত্রে বিবিসিকে জানানো হয়েছে, শুক্রবারের বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয়টাই হবে কীভাবে প্রতিটি কেন্দ্রে একজন বিজেপি (বা বিজেপির শরিক দলের) প্রার্থীর বিরুদ্ধে একজন মাত্র বিরোধী দলীয় প্রার্থীকে দাঁড় করানো যায়।

ভারতের বিরোধী দলগুলো এটাকেই ‘একের বিরুদ্ধে এক’ ফর্মুলা বলে বর্ণনা করছেন – তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে এটা মুখে বলা যত সহজ, কাজে করে দেখানো ততটাই কঠিন!

মূল সমস্যা যেখানে

দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে যথাক্রমে আম আদমি পার্টি ও তৃণমূলের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, ফলে ওই রাজ্যদুটিতে বিরোধীদের মধ্যে আসন সমঝোতা হওয়া খুব কঠিন। এই দুটি রাজ্য মিলে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক আসন আছে।এছাড়া ঝাড়খন্ড, কেরালা বা উত্তরপ্রদেশের মতো আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যে একাধিক বিরোধী দলের রাজনৈতিক ‘স্টেক’ আছে। এই রাজ্যগুলোতেও আছে আরও প্রায় ১৩০টি আসন।অন্ধ্র ও ওড়িশাতে ক্ষমতায় আছে যথাক্রমে ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং বিজু জনতা দল – যে দুটি দলই কংগ্রেস ও বিজেপির থেকে ‘সমদূরত্বে’র নীতি বজায় রাখার কথা বলে।

ফলে ওই দুটি রাজ্যের মোট ৪৬টি লোকসভা আসনে বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও যৌথ বিরোধী প্রার্থী দেওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়।বিজেপিকে হারানোর স্বার্থে এই সব রাজ্যে প্রভাবশালী আঞ্চলিক দলগুলোকে আপসে রাজি করানো এবং কিছু কিছু আসন অন্য দলকেও ছেড়ে দেওয়া – এটা নিশ্চিত করাটাই বিরোধী শিবিরের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ।

কংগ্রেস আবার এখনও মনে করে বিরোধী জোটের নেতৃত্ব তাদের হাতেই থাকা উচিত, কারণ বিরোধী শিবিরে তারাই বৃহত্তম দল এবং জাতীয় স্তরে তারাই বিজেপির একমাত্র বিকল্প। কর্নাটকে তাদের সাম্প্রতিক বিজয় সেই দাবিকেই আরও জোরালো করেছে।কিন্তু অন্য বিরোধী দলগুলো তা মানতে রাজি নয় – যে কারণে তাদের বোঝানোর দায়িত্ব কংগ্রেস নিজের হাতে রাখেনি, বিহারে তাদের জোটসঙ্গী নীতীশ কুমার সেটা এখন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

ওদিকে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস আর তৃণমূলের তিক্ততা ক্রমশই বাড়ছে। রাজ্যে কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশের বিরোধী জোটে "সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা"র নাম হল মমতা ব্যানার্জি।বিরোধী জোট যে কোনও একটি দল বা একজন কোনও বিশেষ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরে নির্বাচনে যেতে পারবে, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

বিরোধী শিবিরে মমতা ব্যানার্জি, শারদ পাওয়ার, নীতীশ কুমার-সহ প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার অনেকেই, এদের কারও নাম জোটের নেতা হিসেবে প্রস্তাব করতে গেলে বিরোধী ঐক্য গড়ে ওঠার আগেই খানখান হয়ে যাওয়ার বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে।পাটনাতে শুক্রবারের মেগা-বৈঠক এই সব সমস্যার সমাধান বের করতে না-পারলেও বিরোধীরা যদি কিছুদিনের ভেতর আবার বৈঠকে বসতে রাজি হন সেটাকেও বিরোধী ঐক্যের পথে রাজনৈতিক অগ্রগতি বলেই ধরতে হবে।

সূত্র : বিবিসি