দু’মাস পরেও অগ্নিগর্ভ মণিপুর, মুখ্যমন্ত্রীর ‘ইস্তফা’ ঘিরে নাটক

দু’মাস পরেও অগ্নিগর্ভ মণিপুর, মুখ্যমন্ত্রীর ‘ইস্তফা’ ঘিরে নাটক

মণিপুরে শান্তি ফেরানোর দাবিতে চেন্নাইতে পদযাত্রার পোস্টার

ঠিক দু’মাস আগে গত ৩রা মে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে যে রক্তাক্ত জাতি-সংঘাত শুরু হয়েছিল তা এখনও থামার কোনও লক্ষণ নেই। রাজ্যে ৩৬ হাজার সেনা ও আধাসেনা মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও গত দু’মাসে মোট প্রাণহানির সংখ্যা অন্তত ১৩৮-এ গিয়ে ঠেকেছে।

শুধুমাত্র গত চব্বিশ ঘন্টাতেই রাজ্যে সহিংসতায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে একজনকে শিরশ্ছেদ করে মেরে ফেলা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।এর মধ্যে শুধু একটিই আশার খবর, রাজ্যের দুটি কুকি বিদ্রোহী গোষ্ঠী গত দু’মাস ধরে কাংপোকপি জেলায় যে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রেখেছিল তা তারা তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।

পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থতার জন্য অনেকেই যার দিকে আঙুল তুলছেন, সেই মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের কথিত ইস্তফা ঘিরেও এর মধ্যে রীতিমতো নাটকীয় কান্ডকারখানা ঘটে গেছে।মুখ্যমন্ত্রী একটি বার্তা সংস্থাকে জানিয়েছেন, ইস্তফা দেয়ার জন্য মনস্থির করে তিনি যখন রাজভবন অভিমুখে রওনা দিচ্ছেন, তখন সমর্থকরা ঘিরে ধরে তাঁকে বাধা দিলে তিনি মত পরিবর্তন করেন।

গত শুক্রবার তিনি টুইটারে ঘোষণাও করেছেন, “এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আমি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াবো না, এটা স্পষ্ট করে দিতে চাই।”ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতেও একটি ছেঁড়া চিঠির ছবি ভাইরাল হয়েছে, যেটিকে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের লেখা ইস্তফাপত্র বলে দাবি করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় অবশ্য সেটির সত্যতা নিশ্চিত করেনি।

এদিকে আজ দিল্লিতে মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এক শুনানিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরফে সলিসিটর তুষার মেহতা দাবি করেছেন, মণিপুরের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, “তবে খুব ধীরে ধীরে।”রাজ্যে সহিংসতার সবশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে ‘আপডেটেড স্ট্যাটাস রিপোর্ট’ জমা দেওয়ার জন্যও মণিপুর সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে ১০ই জুলাই।

পাল্টাপাল্টি হামলা ও গুলি

মণিপুরে জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মেইতেই জাতিগোষ্ঠীর লোক, তারা মূলত সমতল ইম্ফল উপত্যকার বাসিন্দা ও ধর্মীয় বিশ্বাসে হিন্দু।অন্য দিকে রাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ লোক নাগা-কুকি জাতিগোষ্ঠীর, যাদের বসবাস মণিপুরের পাহাড়ি জেলাগুলোতে। তাদের বেশির ভাগই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী।

এই দুই গোষ্ঠীর অধিকারের লড়াইতে এ পর্যন্ত শতাধিক লোক নিহত হয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, শত শত দোকানপাট, গাড়িঘোড়া ও বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।রবিবারের যে পাল্টাপাল্টি হামলায় মোট চারজনের মৃত্যু হয়েছে, সেটাও ছিল দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের জেরে।সরকারি কর্মকর্তারা জানান, মেইতেই-অধ্যুষিত বিষ্ণুপুর জেলার খুইজুমান টাবি গ্রামে ‘পাহাড়ের দিক থেকে চালানো গুলিতে’ গ্রামের তিনজন মেইতেই স্বেচ্ছাসেবী নিহত হন।

‘পাহাড়ের দিক থেকে’ বলতে তারা বোঝাতে চেয়েছেন পার্শ্ববর্তী চূড়াচাঁদপুর জেলার কথা, যেখানে আবার কুকিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।এর আগে রবিবার ভোররাতে চূড়াচাঁদপুরের ল্যাংজা ও চিংল্যাংমেই নামে দুটো গ্রামে হামলা হয়েছিল, তখনই একজন কুকি ব্যক্তির মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়া হয় এবং তিরিশটিরও বেশি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডার্স ফোরাম (আইটিএলএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ডেবিড হমার নামে ওই ব্যক্তির মাথাটা একটা বেড়ার ওপর লটকে রাখা হয়, আর বাকি দেহটা তারা ছুঁড়ে ফেলে দেয় একটি পোড়া বাড়ির ভেতর।”ওই হামলার ‘বদলা’ নিতেই যে খুইজুমান টাবি গ্রামে গুলি চালানো হয়েছিল, পুলিশ ও প্রশাসন তা স্বীকার করে নিচ্ছে। এবং এই ধরনের ‘হিসেব চোকানোর হামলা’ মণিপুরে একটার পর একটা ঘটেই চলেছে।

এরই মধ্যে কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (কেএনও) ও ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (ইউপিএফ) নামে কুকিদের দুটি বড় সংগঠন জাতীয় সড়কে তাদের অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়াতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ আবার শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।এই কুকি সংগঠনদুটো এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর আবেদনে সাড়া দিয়েই তারা অবরোধ তুলে নিয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রী কি দায় নেবেন?

মণিপুরে এই সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকেই বিরোধীরা বারে বারে অভিযোগ করছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা এন বীরেন সিং হিংসা থামাতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন।এন বীরেন সিংকে বরখাস্ত করে রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন দাবিরও জানিয়েছেন অনেকে।

কুকি গোষ্ঠীগুলোও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছে, কারণ তাদের মতে এন বীরেন সিং নিজে একজন মেইতেই বলে তার প্রশাসন মেইতেই-দের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছে।এই প্রবল চাপের মুখেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে কিন্তু পদত্যাগ করবেন বলে এতদিন কোনও ইঙ্গিত দেননি। কিন্তু গত শুক্রবার ইম্ফলে হঠাৎ খবর রটে যায়, মুখ্যমন্ত্রী না কি রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র দিতে যাচ্ছেন।

সঙ্গে সঙ্গে শত শত সমর্থক তাঁর বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে যায়। তারা তাঁকে ঘিরে ধরে দাবি জানাতে থাকে পদত্যাগ করা চলবে না। মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে তাদের সঙ্গে কথাও বলেন।একটা পর্যায়ে সমর্থকরা তাঁর হাত থেকে পদত্যাগপত্র ছিনিয়ে নিয়ে প্রকাশ্যেই সেটি ছিঁড়ে ফেলেন। এই পুরো ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতেও ভাইরাল হয়েছে।পরে সেদিন বিকেলেই মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে জানান, তিনি পদত্যাগ করছেন না। যুক্তি দেন, এই ‘গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে’ সেটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।

পরে বার্তা সংস্থা এএনআই-কে সাক্ষাৎকার দিয়েও তিনি দাবি করেন, “বাড়ি থেকে বেরোতেই যেভাবে হাজার হাজার মানুষ আমাকে ঘিরে ধরে তাদের আস্থা জানালেন, তাতেই আমি বুঝলাম মানুষ আমার সঙ্গেই আছে। তারা বললেই আমি ইস্তফা দেব, না বললে দেব না!”মুখ্যমন্ত্রীর ‘ছিঁড়ে ফেলা পদত্যাগপত্র’র ছবিও ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ে অনেকে আবার ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেও ছাড়ছেন না। বিরোধীরা আবার পুরো ঘটনাটিকে সাজানো নাটক বলেই বর্ণনা করছেন।

সূত্র : বিবিসি