দ্বীপ-রাষ্ট্র সলোমন আইল্যান্ডসকে ঘিরে চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার নেপথ্যে

দ্বীপ-রাষ্ট্র সলোমন আইল্যান্ডসকে ঘিরে চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার নেপথ্যে

দ্বীপ-রাষ্ট্র সলোমন আইল্যান্ডসকে ঘিরে চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার নেপথ্যে

প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ-রাষ্ট্র সলোমন আইল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মানাসিহ সোগাভারে চীনের সঙ্গে একটি বিতর্কিত নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করার পর আজ তার প্রথম সফরে বেইজিং এসে পৌঁছেছেন। মি. সোগাভারের এই সফরের লক্ষ্য চীনের সঙ্গে তার দেশের প্রতিরক্ষা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা। কিন্তু এরই মধ্যে বেইজিং এর সঙ্গে তার দেশের এই ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের মধ্যে মারাত্মক অস্বস্তি তৈরি করেছে।

চীনের সঙ্গে সলোমন আইল্যান্ডস যে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে তার অধীনে চীন ঐ দ্বীপরাষ্ট্রে তাদের দূতাবাসের নিরাপত্তা বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিতে পারবে। পশ্চিমা দেশগুলোর আশংকা এর ফলে চীন প্রশান্ত মহাসাগরে তাদের প্রথম স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি তৈরির সুযোগ পাবে।সলোমন আইল্যান্ডসকে ঘিরে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ওয়াশিংটনে সেখানে তাদের দূতাবাস আবার চালু করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সলোমন আইল্যান্ডসের গুডালকানাল দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি ছিল।

তবে প্রধানমন্ত্রী মানাসিহ সোগাভারে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের এই ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে তারা নিরপেক্ষ থাকতে চান এবং নিজ দেশের উন্নয়নকেই তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তা চুক্তি করার পর বেইজিংয়ে মি. সোগাভারে বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবেন।

এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং নিকটবর্তী কিছু প্রতিবেশী দেশকে বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।সলোমন আইল্যান্ডসের অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগরের এমন একটি জায়গায়, যা কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বীপকে ঘিরে চীনের নৌবাহিনীর বড় কোন পরিকল্পনা আছে বলে সন্দেহ করে পশ্চিমা দেশগুলো।চীনের সঙ্গে সলোমন আইল্যান্ডসের এই ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওয়াশিংটন বেশ তাড়াহুড়ো করে গত মাসে পাপুয়া নিউগিনির সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে।

সলোমন আইল্যান্ডস ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় ৪৫ বছর আগে। গত শুক্রবার স্বাধীনতার ৪৫ তম বার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী মি. সোগাভারে তার ভাষণে বলেছেন, বড় দেশগুলো তার দেশে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কিন্তু তিনি তার দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।তিনি বলেন, “আমরা নিরপেক্ষ থাকতে চাই, কারণ কোন দেশের পক্ষ নেয়া আমাদের দেশ বা জনগণের স্বার্থের জন্য ভালো হবে না। আমাদের জাতীয় স্বার্থ হচ্ছে আমাদের দেশের উন্নয়ন।”তিনি বলেন রাজধানী হোনিয়ারার বাইরে অন্যান্য এলাকায় অবকাঠামোর উন্নয়নও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

চীনের বৃহৎ টেলিকম কোম্পানি হুয়াওয়ে এরই মধ্যে ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয়ে সলোমন আইল্যান্ডসে একটি সেলুলার নেটওয়ার্ক তৈরি করছে। এতে অর্থায়ন করছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। অন্যদিকে চীনের আরেকটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি হোনিয়ারা বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পেয়েছে।মাত্র সাত লাখ মানুষের এই দেশটি চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে বলে আশংকা করছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকরা।চীনে সাত দিনের সফরের সময় মি. সোগাভারে বেইজিং এ তার দেশের দূতাবাসের উদ্বোধন করবেন। তিনি বিভিন্ন চীনা কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন, এবং জিয়াংসু ও গুয়াংডং সফরে যাবেন বলে কথা রয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “চীন এবং সলোমন আইল্যান্ডস প্রশান্ত মহাসাগরের ঐ অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে অবদান রেখেছে এবং এই সফরের সময় দুই দেশের নেতারা আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন।”একটি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মি. সোগাভারে বলেছেন, তার দেশ এক সময় অস্ট্রেলিয়ার সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু তারা এখন তাদের পররাষ্ট্রনীতির মনোযোগ অন্যদিকে নিবদ্ধ করতে চান। তারা চীন, ভারত এবং বিভিন্ন উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে সহযোগিতার নতুন পথ খুঁজতে চান।

মানাসিহ সোগাভারে ক্ষমতায় আসেন ২০১৯ সালে। তিনি তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেন।সলোমন আইল্যান্ডসের রাজধানী হোনিয়ারাতে এবছরের নভেম্বরে প্যাসিফিক গেমস অনুষ্ঠিত হবে। এই গেমস আয়োজনের জন্য চীন সেখানে স্টেডিয়াম তৈরি করে দিয়েছে এবং গেমসের নিরাপত্তার আয়োজনেও তারা সাহায্য করছে। সলোমন আইল্যান্ডসের ৮০ জন অ্যাথলেট চীনে প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন এ সপ্তাহে।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ গ্রেয়াম স্মিথ বলেন, “প্যাসিফিক গেমসের কথা মনে রেখে এই সময়টায় এই সফরের আয়োজন করা হয়েছে এবং সেখানে অ্যাথলেটদের পাঠানো হচ্ছে এবং তারা তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে... চীনা পররাষ্ট্রনীতি কী অর্জন করেছে তা চীনের মানুষকে দেখানোও এর একটা উদ্দেশ্য।”

তিনি বলেন, “এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছে সেজন্যে মি. সোগাভারেকে চীনে বিরাট সম্মান দেখানো হবে।”লোয়ি ইন্সটিটিউটের প্যাসিফিক আইল্যান্ডস প্রোগ্রামের পরিচালক মেগ কিন বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরের ঐ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সলোমন আইল্যান্ডসের সাথেই চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

“প্যাসিফিক গেমস এবং নির্বাচন সামনে রেখে মি. সোগাভারে জাতীয় এবং রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে চীনের কাছ থেকে আরও সহায়তা চাইবেন।”তবে মেগ কিন বলছেন মি. সোগাভারে তার দেশকে নিয়ে যে ভু-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে তার সুযোগ নিয়ে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের দেয়া সাহায্যও গ্রহণ করবেন।

সূত্র : বিবিসি