দাবি আদায়ে চেম্বারে বসছেন না চিকিৎসকরা, রোগীদের ভোগান্তি

দাবি আদায়ে চেম্বারে বসছেন না চিকিৎসকরা, রোগীদের ভোগান্তি

দাবি আদায়ে চেম্বারে বসছেন না চিকিৎসকরা, রোগীদের ভোগান্তি

ঢাকার ধানমণ্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে বাবাকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছিলেন জোবায়ের আহমেদ। সাতদিন আগে তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন। কিন্তু সোমবার দুপুরের দিকে হাসপাতালে এসে দেখতে পান, দুদিন চেম্বার বন্ধ থাকবে বলে নোটিশ ঝুলছে।

“অসুস্থ বাবাকে নিয়ে সাভার থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। প্রতিদিনই তার শরীর আরও খারাপ হচ্ছে, কিন্তু আগামী দুইদিন নাকি ডাক্তার বসবেন না। আশেপাশের কোন হাসপাতালেই নাকি দুদিন ডাক্তার থাকবে না। কী যে করবো বুঝতে পারছি না,’’ বলছিলেন মি. আহমেদ।

সেই হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে এসে ব্যর্থ হয়ে তার মতো আরও অনেকে বসে ছিলেন।ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর পর দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার আর জামিন না দেয়ার প্রতিবাদে সোম এবং মঙ্গলবার ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ ঘোষণা করেছেন চিকিৎসকরা।সেই সঙ্গে গাইনি চিকিৎসকরা ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ রাখার পাশাপাশি অপারেশনের কার্যক্রমও বন্ধ রাখবেন বলে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

হাসপাতালগুলোর যে চিত্র দেখা গেল

সোমবার ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতালে ডাক্তারদের চেম্বারে কোন চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। চিকিৎসা না পেয়ে রোগীরা ফিরে যাচ্ছেন। ল্যাবএইডের মতো কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের চেম্বারের দরজায় নোটিশ ঝুলছে যে, আগামী দুদিন কোন চিকিৎসককে পাওয়া যাবে না।

যেসব হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বসেন, সেইসব হাসপাতালের কল সেন্টার থেকে জানানো হয়েছে, সোমবার এবং মঙ্গলবার কোন চিকিৎসক সেবা দেবেন না।তবে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে জরুরি বা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের হাসপাতালে আসতেও দেখা গেছে।

এর আগেই অবশ্য চিকিৎসকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল যে, ডাক্তাররা চেম্বারে না বসলেও, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা অব্যাহত থাকবে।ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক কাজী রফিকুল আলম বলেন, ‘’আমাদের হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ সব সেবাই চালু রয়েছে। জরুরি সার্জারিও হয়েছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই হাসপাতালে এসেছেন।‘’

বেশিরভাগ নামী হাসপাতালে চিকিৎসকদের চেম্বার বন্ধ থাকলেও, কোথাও কোথাও চিকিৎসকদের চেম্বারে বসতে দেখা গেছে।এরকম একজন সানজিদা রহমান বিবিসিকে বলেন, ‘’আমার দুজন গুরুতর অসুস্থ রোগী রয়েছে। তাদের জন্যই আজ চেম্বারে এসেছি। আমরা একটা দাবির জন্য কর্মবিরতি পালন করছি, কিন্তু রোগীর জরুরি প্রয়োজনে মানবিকতার জন্য হলেও তো আমাদের চিকিৎসা দিতে হবে।‘’

কেন এই আন্দোলন?

গত মাসের ৯ তারিখে স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান জন্ম দিতে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখি। পরদিন অস্ত্রোপচারের পর জন্ম নেয়া নবজাতক মারা যায়। এর কয়েকদিন পর ১৮ই জুন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আঁখিরও মৃত্যু হয়।সেই ঘটনায় চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ এনে আঁখির স্বামী মামলা করলে ওই হাসপাতালের দুজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তাদের গ্রেপ্তার ও জামিন না দেয়ার অভিযোগে দুদিনে কর্মবিরতি ঘোষণা করেছিল গাইনি ও প্রসূতিবিদ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ।পরবর্তীতে চিকিৎসকদের অন্যান্য সংগঠন এই কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়।

গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক সালমা রউফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’কোন ভুল বা চিকিৎসায় কোন জটিলতা থাকলে আমাদের সংশ্লিষ্ট বডি আছে, অধিদপ্তর আছে, মন্ত্রণালয় আছে। তারা তদন্ত করবে। সেখানে কোন ভুল পাওয়া গেলে, শাস্তি হলে অবশ্যই আমরা মেনে নেবো, কিন্তু কোন তদন্ত ছাড়াই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এভাবে গ্রেপ্তার, মাসের পর মাস জেলে রাখা-এটা তো আমরা মেনে নিতে পারি না। রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের নিরাপত্তা যদি না থাকে, তাহলে আমরা কীভাবে চিকিৎসা দেবো?‘’ঢাকার সরকারি একটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলছেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে, মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু সেজন্য চিকিৎসককে জেলে পাঠানো হলে তো কোন চিকিৎসকই আর চিকিৎসা দিতে সাহস পাবেন না।

চিকিৎসকরা দাবি করছেন, চিকিৎসকদের কর্মপরিবেশ নিরাপদ করে সুরক্ষা আইন করতে হবে। সেই সঙ্গে কোন অভিযোগ পেলেই চিকিৎসকদের হয়রানি করা যাবে না।দুইদিনের কর্মসূচী শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে তারা জানিয়েছেন।

রোগীদের জিম্মি করে দাবী আদায়?

রোগীরা অভিযোগ করছেন, রোগীদের চিকিৎসা সেবা আটকে রেখে নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ের চেষ্টা করছেন চিকিৎসকরা।জোবায়ের আহমেদ বলছেন, ‘’তারা দাবি আদায়ে চেম্বার বন্ধ রাখছেন। অনেক সময় হাসপাতালে চিকিৎসা বন্ধ রেখে কর্মবিরতিতে যান। কিন্তু আমাদের মতো রোগীদের কি দোষ? আমরা তো সময় মতো চিকিৎসা পাচ্ছি না।‘’

এর আগেও বাংলাদেশে চিকিৎসকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে আন্দোলন বা দাবি আদায়ের ঘটনা দেখা গেছে। যদিও অত্যাবশ্যকীয় বা জরুরি সেবাসমুহের তালিকায় চিকিৎসা সেবাও রয়েছে।

এই অভিযোগের ব্যাপারে গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক সালমা রউফ বলছেন, ‘’আমরা তো রোগীদের জিম্মি করছি না, বরং উল্টো আমরাই জিম্মি হয়ে আছি। আর রোগীরা একেবারেই যে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তাতো না। দুই তিন ঘণ্টা চেম্বার বন্ধ করায় রোগীরা জিম্মি হবে কেন? এতে রোগীদেরও বড় কোন সমস্যা হওয়ার কথা না, কারণ হাসপাতালের জরুরি সেবা, অভ্যন্তরীণ সেবা তো চালু আছে।‘’

চিকিৎসকদের চেম্বার বন্ধ এবং অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখায় রোগীদের ভোগান্তি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে সোমবার স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেছেন, ‘’এটা মানবিক না। চিকিৎসকদের বোঝা উচিত যে কাজটি করছেন, সেটি সঠিক হচ্ছে কি না। রোগী জিম্মি করা তো কোন বিষয়ের মধ্যে পড়ে না। চিকিৎসকদের মানবিক হতে হবে, রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেন? আমি মনে করি, তাদের এখান থেকে ফিরে আসা জরুরি।‘’

ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘’চিকিৎসকরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কর্মসূচি দিয়েছেন, তবে আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো চালু আছে, সব ধরনের সেবা চালু আছে। আমার বিশ্বাস, এ সমস্যা থাকবে না, দুই একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আমরা কথা বলেছি, দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।‘’

সূত্র : বিবিসি